ভূমিকা :
পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পাকিস্তানের জাতীয় নেতৃত্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক মিশ্রণের এক কেন্দ্রীভূত নীতি গ্রহণ করে। এ নীতির চাপ অধিক মাত্রায় অনুভূত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানে তথা পূর্ব বাংলায় । বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করতে শাসকগোষ্ঠী চরম উপেক্ষা প্রদর্শন করে । শুধু ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে । এতে পূর্ববাংলার যুব সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী ও সর্বোপরি আপামর জনসাধারণের মধ্যে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়— তাদের মনে চাপা অসন্তোষ বিরাজ করে । আর এ হতাশা ও অসন্তোষের তীব্র ও ব্যাপক প্রসার ঘটে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ।
ভাষা আন্দোলন :
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬% লোকের মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে মাত্র ৭.২% লোকের মাতৃভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এরই প্রতিবাদে পূর্ববাংলার আপামর জনসাধারণ তাদের প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করার দাবিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে দুর্বার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজধানীর রাজপথ রঞ্জিত করে এক অসাধারণ ও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। বাংলার ইতিহাসে এ আন্দোলনই ভাষা আন্দোলন নামে খ্যাত ।
ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব :
ভাষা আন্দোলন মূলত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম ও অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বস্তুত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ ঘটিয়ে স্বাধীন বাংলার আত্মপ্রকাশের প্রতি স্তরে প্রেরণা যুগিয়েছে ভাষা আন্দোলনের রক্তমাখা ইতিহাস। নিম্নে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. একক রাজনৈতিক প্লাটফর্মের অধীনে আনয়ন করে :
ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের একটি একক রাজনৈতিক প্লাটফর্মের অধীনে একত্রিত করে এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়, অত্যাচার ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার আদায়ের মন্ত্রে দীক্ষিত করে ।
২. জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটায় :
এ আন্দোলন পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে নব জাতীয় চেতনা তথা বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটায়। অধিকার বঞ্চিত বাঙালি জাতির মনে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয় ।
৩. আন্দোলনে প্রেরণা ও সাহস যোগায় :
ভাষা আন্দোলন এদেশের বুদ্ধিজীবীদেরকে জনগণের সাথে একাত্ম করে তোলে এবং সমগ্র জাতিকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে । ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে যে বৈপ্লবিক চেতনা ও সংহতিবোধের সৃষ্টি হয়, তা পরবর্তী সকল আন্দোলনে প্রাণশক্তি, সাহস ও প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে ।
৪. সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায় :
ভাষা আন্দোলনের শিক্ষাই বাঙালিদেরকে স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে ।
৫. অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে :
ভাষা আন্দোলনের ফলেই বাঙালি জাতি তার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়। বাঙালি জাতি স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কবল থেকে নিজেদের মাতৃভূমিকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে সক্ষম হয় ।
৬. গণদাবি আদায়ের শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা দান করে :
ভাষা আন্দোলনই সর্বপ্রথম রক্তের বিনিময়ে জাতীয়তাবাদী গণদাবি আদায়ের শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা দান করে। এই দৃষ্টান্ত থেকেই বাঙালি জাতি তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার মতো দুর্জয় সাহস, সংকল্প ও অনুপ্রেরণায় বলীয়ান হয়ে উঠে।
৭. প্রতিবাদে সাহস যুগিয়েছে :
ভাষা আন্দোলনই এ দেশবাসীকে স্বৈরাচারী শাসন ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ব্যবস্থার অবসানকল্পে সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে সাহস যুগিয়েছে ।
৮. হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় :
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন ছিল। এ আন্দোলনের ফলেই পূর্ববাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় ।
৯. বাঙালি এলিট শ্রেণীর উদ্ভব :
ভাষা আন্দোলনের ফলেই পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি এলিটদের বিপরীতে বাঙালি এলিট শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলন বাঙালি এলিট শ্রেণীকে প্রয়োজনীয় গণআবেদন এবং
গোষ্ঠী সংহতি প্রদান করে ।
১০. প্রত্যক্ষ সংগ্রাম :
১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন নিয়েই বাঙালি জাতি সর্বপ্রথম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হয় । ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েই বাঙালি জাতি পাকিস্তানি শাসকচক্রের প্রতিটি ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয় ।
১১. মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় :
ভাষা আন্দোলনের প্রতি পূর্ববাংলার মানুষের সার্বিক সমর্থনের ফলস্বরূপ ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিকট শাসক দল মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে । যুক্তফ্রন্ট তাদের ২১ দফা কর্মসূচির প্রথম দফাতেই বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবি জানায় । ১২. পারস্পরিক সন্দেহের সৃষ্টি : ভাষা আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে তিক্ততা ও
পারম্পরিক সন্দেহের সৃষ্টি হয় ।