১১ প্রশ্ন : ৪.৩। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও গুরুত্ব আলোচনা কর। অথবা, ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

ভূমিকা : 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালিদের গণচেতনার প্রথম বহিঃপ্রকাশ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ । মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এ আন্দোলন পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনসমূহকে একধাপ এগিয়ে দেয় । অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগণের মধ্যে এ আন্দোলন এক নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায় । এ নব চেতনাই ক্রমে ক্রমে পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় । জনগণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বহুগুণ বাড়িয় দেয় এ আন্দোলন । ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়ই অর্জিত হয় বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বাধীনতা ।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির ভৌগোলিক কাঠামোর অধীনে পূর্ব বাংলার জনসাধারণ নিজেদের সাংস্কৃতিক সত্তা ও ঐতিহ্যকে বিকশিত করার যে সুপ্ত আশা পোষণ করতে থাকে তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় । 

পাকিস্তানের গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুকে নির্বাচন করা হলে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন ।

 কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ভাষা হবে বলে ঘোষণা করেন । তার এ ঘোষণার প্রতিবাদে এবং ধীরেন্দ্রনাথের প্রস্তাব অগ্রাহ্য হওয়ায় বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষা করার দাবিতে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয় এবং ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় । 

অতঃপর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে পূর্ব বাংলার সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট পালনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সর্বজনীন রূপ লাভ করে।

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতাদান কালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ভাষা।” জিন্নাহর এ অবিবেচক, স্বৈরাচারী মনোভাব পূর্ব বাংলার ছাত্র, বুদ্ধিজীবি তথা সর্বস্তরের মানুষের মনে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ভাব সৃষ্টি করে । 

ফলে ভাষা আন্দোলন ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এতদসত্ত্বেও ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে আয়োজিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পুনরায় নির্লজ্জভাবে ঘোষণা করেন যে “একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা” । 

এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করে । এভাবে আন্দোলন ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠার পটভূমিতে পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার সকল দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”। 

এভাবে বাংলা ভাষার দাবি জাতীয়ভিত্তিক সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে নতুন প্রাণ খুঁজে পায় এবং বলতে গেলে তখন থেকে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের চরম বিকাশ সাধিত হয়। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট শেষে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান করা হলে ভাষা আন্দোলনের গতি আরো বেগবান হয়ে উঠে ।

২১ ফেব্রুয়ারি আহুত ধর্মঘটের প্রতি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পূর্ণ একাত্মতা ঘোষণা করলেও পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের প্রশাসন ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি ও সকল প্রকার সভা সমাবেশ মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। 

এতদসত্ত্বেও বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজ ২১ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত ধর্মঘট পালনের জন্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ধ্বনিতে রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলে । ফলে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ তরুণরা শহীদ হন এবং আরো অনেকে আহত ও অনেকে বন্দী হয় এবং পরিস্থিতির অবনতি দেখে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয় । ভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির এ ঘটনা বাংলা তথা বিশ্বের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন নামে খ্যাত ।

ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব : ভাষা আন্দোলন মূলত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম ও অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী । নিম্নে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :

১. একক রাজনৈতিক প্লাটফর্মের অধীনে আনয়ন করে :

ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের একটি একক রাজনৈতিক প্লাটফর্মের অধীনে একত্রিত করে এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়, অত্যাচার ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার আদায়ের মন্ত্রে দীক্ষিত করে ।

২. জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটায় : 

এ আন্দোলন পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে নব জাতীয় চেতনা তথা বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটায়। অধিকার বঞ্চিত বাঙালি জাতির মনে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয় ।

৩. আন্দোলনে প্রেরণা ও সাহস যোগায় : ভাষা আন্দোলন এদেশের বুদ্ধিজীবীদেরকে জনগণের সাথে একাত্ম করে তোলে এবং সমগ্র জাতিকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে । ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে যে বৈপ্লবিক চেতনা ও সংহতিবোধের সৃষ্টি হয়, তা পরবর্তী সকল আন্দোলনে প্রাণশক্তি, সাহস ও প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে ।

৪. অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে :

 ভাষা আন্দোলনের ফলেই বাঙালি জাতি তার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়। বাঙালি জাতি স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কবল থেকে নিজেদের মাতৃভূমিকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে সক্ষম হয় ।

৫. প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার সাহস যোগায় : 

১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন নিয়েই বাঙালি জাতি সর্বপ্রথম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হয় । ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েই বাঙালি জাতি পাকিস্তানি শাসকচক্রের প্রতিটি ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয় ।

৬. মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় : ভাষা আন্দোলনের প্রতি পূর্ববাংলার মানুষের সার্বিক সমর্থনের ফলস্বরূপ ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিকট শাসক দল মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে যুক্তফ্রন্ট তাদের ২১ দফা কর্মসূচির প্রথম দফাতেই বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবি জানায় ।

৭. ঐক্যজোট গঠনের রীতির সূত্রপাত : 

ভাষা আন্দোলন ছাত্রসমাজকে একটি প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করে এবং ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও পেশাদার শ্রেণীর ঐক্যজোট গঠনের রীতির সূত্রপাত করে । এরূপ ঐক্যজোটকে পরবর্তী সকল আন্দোলনের ক্ষেত্রে সফলতার সাথে কাজে লাগানো হয় ।

৮. সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায় : 

ভাষা আন্দোলনের শিক্ষাই বাঙালিদেরকে স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে ধাপে ও স্তরে প্রেরণা যুগিয়েছে ভাষা আন্দোলনের রক্তরাঙা ইতিহাস । এ আন্দোলনই বাঙালিদেরকে ঐক্যের দুর্ভেদ্য প্রাচীর গঠন এবং অধিকার আদায়ে ইস্পাত কঠিন শপথে বলীয়ান করে পর্যায়ক্রমে গণআন্দোলনের রক্তপাতের সিঁড়ি বেয়ে পরিণামে স্বাধীনতার ছাড়পত্র ছিনিয়ে আনতে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে এবং বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related