মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশ কে কবে জারি করেন

১১ প্রশ্ন : ৪.১। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এর ইতিহাস বর্ণনা কর। অথবা, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা কর।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস

ভূমিকা :

ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্যসাধারণ ঘটনা । ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই । সে দিক থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল এক ভিন্নধর্মী ও বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন । পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের মধ্যে সর্বপ্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তার উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে পূর্ববাংলার জনসাধারণ তাদের বিভিন্ন ন্যায়সংগত দাবি আদায়ের আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও সর্বোপরি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে সক্ষম হয় । ভাষা আন্দোলন : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয় ।

পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬% লোকের মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে মাত্র ৭.২% লোকের মাতৃভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এরই প্রতিবাদে পূর্ববাংলার আপামর জনসাধারণ তাদের প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করার দাবিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে দুর্বার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজধানীর রাজপথ রঞ্জিত করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে । বাংলার ইতিহাসে এ আন্দোলনই ভাষা আন্দোলন নামে খ্যাত।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি বা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বপ্রথম পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত আন্দোলন শুরু হয় সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে । জন্মলগ্ন থেকেই সংগঠনটি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করে আসছিল । কিন্তু এ দাবি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ কিছুতেই মেনে নিতে রাজি ছিলেন না । পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ করতে সচেষ্ট হন । ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে ইংরেজি ও উর্দুর সাথে বাংলা ভাষা ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হলে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন, “আন্দোলনকারীদের বুঝা উচিত যে, পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে উপমহাদেশের একশত কোটি মুসলমানদের দাবির প্রেক্ষিতে এবং এ একশত কোটি মুসলমানের ভাষা হলো উর্দু। শুরু হয় বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র । যথাসময়ে এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধ্বনি উত্থিত হয় ।

পূর্ববাংলা মুসলিম ছাত্র লীগের ইশতেহারে রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করা হয়। এ ইশতেহারই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ঘৃণ্য কার্যকলাপ ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। পাকিস্তানি শাসকদের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে ন্যক্কারজনক কার্যকলাপের প্রতিবাদে পূর্ববাংলার মানুষের অভিপ্রায় স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যে ছাত্রসমাজ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট পালন এবং বিক্ষোভ সভা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করে । ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ (Urdu and only Urdu, shall be the state language of Pakistan), তার এ দম্ভপূর্ণ ঘোষণার প্রতিবাদ করা হয় তাৎক্ষণিকভাবে ।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাংলা ভাষার দাবিকে বিনষ্ট করার জন্য দমনমূলক নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং ভাষা আন্দোলনের সমর্থকদের জেলে আটক করেন । ফলে চারদিকে প্রতিবাদের ঝড় উত্থিত হয়ে প্রবল আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও জনগণ সম্মিলিতভাবে আটককৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করে। ১৯৫০ সালে লিয়াকত আলী খান গণপরিষদে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে মূলনীতি কমিটির একটি রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্টটিতে নগ্নভাবে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলা হয়। ফলে এটি পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ ও জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। ইতোমধ্যে ভাষা আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ১৯৫২ সালে একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠন করা হয় ।

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন পল্টন ময়দানে এক জনসভায় জিন্নাহর ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এ বক্তব্যের প্রতিবাদে পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকায় প্রতিবাদ সভা এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগানসহ মিছিল চলতে থাকে ।

৪ ফেব্রুয়ারি সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় । ইতোমধ্যে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ববাংলা ব্যাপী ধর্মঘট, সভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের আহ্বান জানায় । ভাষা আন্দোলনের প্রকৃতি ও অগ্রগতি : ভাষা আন্দোলন যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে এবং এক জঙ্গি আন্দোলনে পরিণত হয় তখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যুক্তিবোধের পরিবর্তে সামরিক আয়োজন গ্রহণ করেন । আন্দোলনকে বানচাল করার মানসে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেন । সামরিক আয়োজনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে পূর্ববাংলায় নূরুল আমীন সরকার ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাত্রি থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন এবং সকল প্রকার সভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।

কিন্তু সংগ্রামী ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে পূর্বনির্ধারিত ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” স্লোগান তুলে তদানীন্তন প্রাদেশিক ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাদের হৃদয় নিংড়ানো অভিপ্রায় জানানোর চেষ্টা করলে পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ফলে পুলিশের গুলিবর্ষণে বরকত, সালাম, জব্বার, রফিক প্রমুখ অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ শাহাদাতবরণ করেন । এ সংবাদ মুহূর্তে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে পূর্ববাংলা বিপ্লবের আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়, যার গলিত লাভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে।

অধিকার সচেতন জনগণ পাকিস্তানিদের আসল স্বরূপটা জানতে পেরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রলয়ঙ্করী গর্জনে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এভাবে ভাষা আন্দোলন এমনই দুর্বার আন্দোলনে পরিণত হয় যে, এর চাপে পড়ে পাকিস্তান সরকারের সব অহমিকা ও শক্তি মুহূর্তের মধ্যে ধুলায় লুটিয়ে পড়ে এবং ১৯৫৬ সালে রচিত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিতে বাধ্য হন। বাংলা ভাষা সুপ্রতিষ্ঠিত হয় সুমহান মর্যাদার আসনে বহু রক্তের বিনিময়ে ।

বাংলা ভাষা আন্দোলন

উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে ধাপে ও স্তরে প্রেরণা যুগিয়েছে ভাষা আন্দোলনের রক্তরাঙা ইতিহাস। এ আন্দোলনই বাঙালিদেরকে ঐক্যের দুর্ভেদ্য প্রাচীর গঠন এবং অধিকার আদায়ে ইস্পাত কঠিন শপথে বলীয়ান করে পর্যায়ক্রমে গণআন্দোলনের রক্তপাতের সিঁড়ি বেয়ে পরিণামে স্বাধীনতার ছাড়পত্র ছিনিয়ে আনতে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে এবং বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করে স্বাধীন- সার্বভৌম বাংলাদেশ ৷