ভূমিকা :
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালিদের গণচেতনার প্রথম বহিঃপ্রকাশ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ । মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এ আন্দোলন পূর্ববাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনসমূহকে একধাপ এগিয়ে দেয় । অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগণের মধ্যে এ আন্দোলন এক নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায় । এসব চেতনাই ক্রমে-ক্রমে পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় । জনগণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় এ আন্দোলন । ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়ই অর্জিত হয় বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বাধীনতা
ভাষা আন্দোলন :
ঐতিহাসিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথমেই দেখা দেয় ভাষা সমস্যা। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব থেকেই পশ্চিমা স্বার্থান্বেষী মহল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা করতে থাকে। বাংলার জাতীয় ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ঘটনার বীজ রোপিত হয় যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই নিখিল পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ জনগণের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ও ছাত্রের উদ্যোগে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামক সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে আন্দোলন শুরু হয়, তা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’সহ বিভিন্ন সংগঠনের অধীনে ধর্মঘট, হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো নাম না জানা শহীদের জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে । এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন হিসেবে অভিহিত ।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব/ফলাফল/গুরুত্ব :
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সময়ে ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলি বাঙালিদের স্বাধিকার অর্জনের প্রচেষ্টাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। ভাষা আন্দোলন নিছক একটি প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না, এর তাৎপর্য ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব / ফলাফল / গুরুত্ব নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. জাতীয় চেতনার সূচনাকারী :
নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে সংগঠিত জাতীয় চেতনার সূত্রপাত ঘটায়। এ আন্দোলনের চরম ত্যাগের মহিমা বাঙালি জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে জাতীয়রূপ প্রদান করে। পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামসমূহে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে যে জাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে তার উন্মেষ ঘটে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ।
২. ধর্মনিরপেক্ষ জাগতিক চিন্তার বিকাশ :
পাকিস্তানের ধর্মীয় ভিত্তি দুর্বল করে দেয় ভাষা আন্দোলন। তদস্থলে জাতি গঠনে নিরপেক্ষ ও জাগতিক ধারণার জন্ম দেয় । ধর্ম যেকোনো জাতির ঐক্যবদ্ধতার একমাত্র প্রতীক নয়; বরং ভাষাও যে অপরিহার্য উপাদান তার স্বীকৃতি প্রথম সূচিত হয় এ আন্দোলনে । পৃথিবীর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে ভাষাকে কেন্দ্র করে এ জাতীয় আন্দোলনে বাঙালি জাতিই সর্বপ্রথম এ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছে ।
৩. জাতীয় একাত্মতা ও সংহতির জন্মদাতা :
পাকিস্তান আন্দোলনের সময় এদেশের বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় যে মুসলিম জাতীয়তাভিত্তিক একাত্মতা ও সংহতির চেতনা সৃষ্টি করেছিল, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন সে জায়গায় নবতর ও ভিন্নতর জাতীয় একাত্মতা ও সংহতিবোধ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি অপশাসন ও অপচেষ্টার কারণে বাঙালিরা নিজেদেরকে স্বদেশে পরদেশি ভাবতে বাধ্য হয় এবং নতুন জাতিসত্তার সন্ধানে এগিয়ে আসে ।
৪. বিপ্লব ও বিদ্রোহের প্রেরণা :
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে বিপ্লবী হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায় এবং তাদের অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উদ্দীপনা সৃষ্টি করে । অন্যায়কে মেনে না নিয়ে তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিদ্রোহ করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা যে জরুরি সে শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভূমিকা অসামান্য । এর মধ্য দিয়ে জাতি বারবার তার উপর আসা আক্রমণ প্রতিহত করার শিক্ষা লাভ করে ।
৫. মধ্যবিত্ত বাঙালিদের উত্থান :
ভাষা আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণী:
পাকিস্তানের পূর্বাংশের রাজনীতিতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত সবক’টি আন্দোলনেই নেতৃত্বের রশি থাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে। ফলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে পুঁজিপতি শ্রেণীর একচেটিয়া প্রভাব বাধাগ্রস্ত হয় ।
৬. রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত :
প্রথম অবস্থায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য । কিন্তু ভাষার দাবি পূরণের জন্য যেহেতু রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছিল, সেহেতু তা রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে । এ আন্দোলনে সর্বস্তরের বাঙালি জনগণের অংশগ্রহণের কারণ ছিল তিনটি । যথা- (ক) পাঞ্জাবি আমলা ও সেনাচক্রের গণবিরোধী স্বায়ত্তশাসন বা বিরোধী-শাসন, (খ) অর্থনৈতিক শোষণ এবং (গ) বাঙালিদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ । ফলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিছক ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জনগণের দাবি হয়ে গণআন্দোলনের রূপ নিয়েছিল ।
৭. গণতান্ত্রিক চেতনার সৃষ্টি :
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে মুষ্টিমেয় লোকের মুখের ভাষা উর্দুকে জাতীয় ভাষা করার পাঁয়তারা চালায় । বাঙালিরা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একটি অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে রুখে দাঁড়ায় । ভাষা আন্দোলন এ সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করে যে, গণতন্ত্রের মূলভিত্তি হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন ও স্বীকৃতি । যেকোনো পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত জনসমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হলে তা বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয় । গণতান্ত্রিক চেতনার আলোকে বীর বাঙালি বারবার ব্যর্থ করে দেয় সকল কূটচক্র ও ষড়যন্ত্র ।
৮. বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ :
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালিরা সর্বপ্রথম নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা, স্বতন্ত্র অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে । পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সাথে শুধু ধর্মের বন্ধন ছাড়া বাঙালিদের যে আর কোনো সম্পর্ক নেই, সে সম্পর্কে তারা প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। ১৯৫২ সালের মহান একুশের রক্তদানের মধ্য দিয়ে যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত হয়, সে চেতনা থেকেই ২১-এর প্রতীক ২১-দফা প্রণয়ন করে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী বাঙালি নেতৃবৃন্দ ১৯৫৪ সালে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাংলার মাটিতে খাজা নাজিমউদ্দীন, নূরুল আমীনের পকেট সংগঠন মুসলিম লীগের কবর রচিত হয় । ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আরো বিকশিত হতে থাকে ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। বস্তুত বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন এক নতুন দিগ্দর্শন । এ আন্দোলন বাঙালিদের মনে যে বৈপ্লবিক চেতনা ও ঐক্যের উন্মেষ ঘটায়, তা দেশটির পরবর্তী সকল আন্দোলনে প্রাণশক্তি ও অনুপ্রেরণা যোগায় । ভাষা আন্দোলনের চেতনা ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটায় । ভাষা আন্দোলন তুলে ধরে বাঙালিদের নতুন পরিচিতি; বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলসূত্রই নিহিত রয়েছে ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে ।