১১ প্রশ্ন : ১.৭। বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা কিভাবে ঘটে বর্ণনা কর। অথবা, বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ঘটে কিভাবে? ব্যাখ্যা কর।

বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা:

 প্রকৃতিকে জয় করে, বশীভূত করে প্রকৃতির প্রভু হয়ে মানুষ কৃত্রিমভাবে যে জীবনযাপন করে— সেটাই তার সংস্কৃতি ও সভ্যতা। এদেশের মানুষ কখনো স্বকীয় মেজাজে আত্মবিকাশের সহজ ও স্বাভাবিক পথ পায়নি । প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে যেসব বণিক, পর্যটক, ধর্মপ্রচারক বাংলাদেশে এসেছে, তারা বাঁঙালিকে ভীরু, মিথ্যাভাষী, প্রতারক, কলহপ্রিয়, দরিদ্র ও চোর বলে জেনেছে । মূলত সংস্কৃতি বহতা নদীর মতো প্রবহমান ও গতিশীল । তাই সংস্কৃতির এ সচল প্রবাহই বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতার পেছনে দায়ী ।

বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা যেভাবে ঘটে : বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা যেভাবে ঘটে তা নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :

-১. আর্য-সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ :

 আর্য বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই এদেশের উচ্চবিত্তের ও আভিজাত্যের লোকগুলো আর্য সমাজে মিশে গিয়েছিল । আর্যদের বসবাসের সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর ভারত ‘আর্যাবর্তে’ পরিণত হয়। আর্যরা বহুকাল ধরে এ দেশে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে শাসনকার্য চালায় । ফলে তাদের সংস্কৃতির সাথে দেশীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণে নতুন এক সংস্কৃতির সৃষ্টি হয় ।

২. অস্ট্রিক মঙ্গোলদের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ :

 অস্ট্রিক মঙ্গোলদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে— সেটাই চিরকাল বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা । তার প্রভাব থেকে বাঙালি কখনো মুক্ত হতে পারবে না। বাঙালির চেতনায়, স্নায়ুতে, রক্তধারায় তা মিশে আছে যুগ যুগ ধরে। সাংখ্য, যোগ, তন্ত্র, দেহতন্ত্র এগুলো হচ্ছে বাংলার আদি মঙ্গোলদের দান । আর নারী দেবতা, পশুপাখি ও বৃক্ষদেবতা, জন্মান্তরবাদ প্রভৃতি হচ্ছে অস্ট্রিকদের দান । এ সকল বৈশিষ্ট্য বাঙালির চরিত্রে ও জীবনে অন্তর্নিহিত । বাঙালি বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, ইসলাম প্রভৃতি ধর্ম গ্রহণ করে নানা সম্প্রদায়ের রূপ লাভ করেছে বটে, কিন্তু কখনো সে সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্রের প্রভাব ত্যাগ করতে পারেনি । ফলে বহিরাগত প্রতিটি মতবাদ এখানে এসে নতুন রূপ লাভ করেছে, নতুন চরিত্র নিয়েছে, বাঙালি রূপ নিয়েছে ।

৩. বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের অনুপ্রবেশ :

 আর্য-অনার্যের বিভেদ যখন ঘুচে যায়, তখন দেশ বা মানুষের কাছে বুদ্ধ মহাবীরের বাণী পৌছে দেবার পক্ষে কোনো বাধা থাকে না । এ সময়েই প্রথম জৈন ও বৌদ্ধ ভিক্ষুকগণ মগধের সীমা অতিক্রম করে আধুনিক বাংলাদেশে নবধর্ম প্রচারের জন্য উপস্থিত হন। এদেশের বর্বর প্রায় জনগণের মধ্যে আর্যভাষা ও সংস্কৃতির আবরণে এই দ্রোহী ধর্ম অর্থাৎ জৈন— বৌদ্ধ মতবাদ প্রচারিত হয়। এদের লিপি ছিল না, সাহিত্যের শালীন ভাষা ছিল না, উঁচুমানের সংস্কৃতি ছিল না । তাই আর্য ধর্মের সাথে আর্যভাষা, সংস্কৃতি তাদের বরণ করে নিতে হয় । বাংলার পাল রাজাগণ বৌদ্ধ ছিলেন । তাই তাদের সময়ে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম টিকেছিল । সেন রাজাগণ ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন।

৪. বিদেশি শাসন : 

বাঙালিরা চিরকালই বিদেশি ও বিজাতি শাসিত জাতি । সপ্তম শতকের শশাঙ্ক-নরেন্দ্র গুপ্ত এবং পনেরো শতকের যদু-জালালুদ্দিন ছাড়া বাংলার কোনো শাসকই বাঙালি ছিলেন না। এটি নিশ্চিতই লজ্জার এবং বাঙালি চরিত্রে নিহিত রয়েছে এর গূঢ় কারণ । দীর্ঘকাল বিদেশিদের দ্বারা শাসিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই শাসক শ্রেণীর সংস্কৃতির অবাধ অনুপ্রবেশ যে আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

৫. ইসলাম ধর্মের অনুপ্রবেশ :

 উপমহাদেশে তুর্কি বিজয়ের সাথে সাথে ইসলাম ধর্মের প্রবেশ ঘটে ব্যাপকভাবে । যদিও অতীতে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু মুসলিম বণিক বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এদেশে গমন করেছিল কিন্তু চূড়ান্তভাবে এদেশে ইসলাম প্রবেশ করে তুর্কি বিজয়ের পরে । এরপর আফগান ও মুঘল শাসনামলে এবং আরব-ইরানি ও মধ্য এশীয় বহু উপজাতির প্রভাবে সুদীর্ঘ প্রায় ৭০০ বছর মুসলমানরা এ এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। মুসলমানদের এই দীর্ঘ শাসনের ফলে জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এসেছে নানা পরিবর্তন

 

৬. নতুন নতুন ধর্মমতের প্রচলন ।

 বাঙালির ধর্মচিন্তাকে প্রভাবিত করেছে লৌকিক ধর্ম, জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম, নাথধর্ম, ইসলাম ধর্ম প্রভৃতি। বাঙালির এ সকল ধর্মচিন্তাও সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে । যে কারণে সম্রাট আকবর উপমহাদেশের প্রধান প্রধান ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন নতুন এক ধর্মমত যা দ্বীন-ই-ইলাহী নামে পরিচিত ।

৭. বিদেশি পর্যটক ও পরিব্রাজকের আগমন :

 অতীতে ধর্মপ্রচারক, পরিব্রাজুক এবং পণ্ডিতগণ বিভিন্ন দেশে গমনাগমনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং আদান-প্রদানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন । আমাদের এ অঞ্চলে চীনের হিউয়েন সাং, মরক্কোর ইবনে বতুতা, ইতালির মার্কো পোলো প্রমুখ বিদেশি পর্যটক তথা পরিব্রাজকের আগমনও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

 আবহমান বাংলার সংস্কৃতি, কৃষ্টি, চিন্তা-চেতনা, মনন-সাধনা ও ধর্ম এসব মিলিয়েই গড়ে উঠেছে বাঙালির দর্শন । রাঙালির উল্লেখযোগ্য দর্শসনমূহ হলো লোকায়ত দর্শন, বৈষ্ণৱ দৰ্শন, সুফি দর্শন, বাউল দর্শন, চার্বাক দর্শন প্রভৃতি । যা মূলত প্রকাশ পেয়েছে মানবতাবাদ ও ভক্তিবাদের মধ্য দিয়ে । বাঙালির সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতার ক্ষেত্রে এটিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ।

৯. ব্যবসা-বাণিজ্য :

 ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে বাঙালিদের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গমন এবং সেখানকার বণিকদের এদেশে আগমন ছিল নিয়মিত ব্যাপার । তাই ক্রিটবাসীর সঙ্গে প্রাচীন বাঙালির সংস্কৃতির যোগও ছিল স্বাভাবিক । এর প্রমাণও মেলে, ক্রিটে প্রচলিত লিপির সঙ্গে বাংলার ‘পাঞ্চ মার্কযুক্ত’ মুদ্রায় উৎকীর্ণ লিপির সাদৃশ্য থেকে ।

উপসংহার : 

পরিশেষে বলা যায়, বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা যে সংস্কৃতি বহন করছি তা আমরা বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মাধ্যমে পেয়েছি । বস্তুত, বিভিন্ন শাসক, পরিব্রাজক, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপট থেকেই আমরা বাঙালি সংস্কৃতি পেয়েছি । আর এভাবেই বিভিন্ন অনুঘটক-ঘটকের মাধ্যমেই বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ঘটেছে ।

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related