১১ প্রশ্ন : ২.১। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয় কেন? এটা কি অপরিহার্য ছিল? অথবা, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির কারণ লিখ ।

ভারত বিভক্ত

 ভূমিকা :

 ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিম এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা ভারত বিভক্তির মূল কারণ । কংগ্রেসের মাত্রাতিরিক্ত অন্ধের মতো হিন্দু ঘেঁষানীতিই ভারত বিভক্তিকে অনিবার্য করে তোলে ।

 এর ফলে মুসলিম জাতীয়তাবাদের জন্ম হয় ! তারা গড়ে তোলে দুর্বার আন্দোলন। আন্দোলনের তীব্রতা সুদূর লন্ডন সরকারও অনুভব করে । ফলে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয় ।

১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির কারণ :

 ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির কারণগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো :

  কংগ্রেসের জন্ম ও হিন্দুঘেঁষা নীতি :

 ১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিন্দু- মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের দাবি-দাওয়া ও স্বার্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কংগ্রেস মুসলমানদের স্বার্থ উপেক্ষা করে শুধুমাত্র হিন্দুদের স্বার্থরক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করে । এমনকি কংগ্রেস ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের নিকট মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করতে থাকে । ফলে ভারতবর্ষের মুসলমানরা নিজেদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে ভাবতে থাকে এবং নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে সচেষ্ট হয় ।

বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা :

 ১৯০৫ সালে প্রশাসনিক বিশেষ করে পূর্ববাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের সুবিধার্থে বঙ্গভঙ্গ করার পর কংগ্রেস ও হিন্দুসভা এর বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু করে । তারা বঙ্গভঙ্গকে ‘বঙ্গমাতার ব্যবচ্ছেদ’ বলে উল্লেখ করে । ফলে হিন্দুদের আক্রমণের মুখে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করায় মুসলিম সম্প্রদায় দারুণ হতাশায় নিমজ্জিত হয় ।

মুসলিম লীগ গঠন ও স্বতন্ত্র পন্থা অবলম্বন :

 কংগ্রেসের হিন্দু ঘেঁষানীতি এবং উগ্র হিন্দুদের বিরোধিতা মোকাবিলা করার জন্য এবং মুসলমানদের অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে ১৯০৬ সালে ঢাকায় ‘সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ’ গঠন করা হয়। লীগের দাবির মুখে ১৯০৯ সালে মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইনে মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হলে এবারও কংগ্রেস এবং হিন্দুসভা এর তীব্র বিরোধিতা করে ।

 জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব ঘোষণা :

 ১৯৩৯ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার বিখ্যাত দ্বিজাতি তত্ত্ব ঘোষণা করেন । এর মূলকথা হলো মুসলমানগণ ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নয়; বরং হিন্দু-মুসলিম ভারতের দুটি স্বতন্ত্র জাতি । তাই মুসলমানদের একটি পৃথক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র থাকতে হবে ।

 এ উক্তির মাধ্যমে জিন্নাহ বাংলাকে বিভক্ত করে উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলের বৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত এলাকার সাথে যুক্ত একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দেন । এর ফলে বাংলার নির্যাতিত মুসলমানগণ আশান্বিত হয়ে উঠে

লাহোর প্রস্তাব :

 ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে জিন এর ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ আলোকে ভারতবর্ষে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয় । অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন ।

 ২৪ মার্চ প্রস্তাবটি গৃহীত হয় । এ প্রস্তাবের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বভাগের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে নিয়ে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ গঠন করতে হবে। ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে আইনসভার মুসলিম লীগ সদস্যের একটি বিশেষ কনভেনশনে ‘একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ কথাটি সংশোধন করে ‘এটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র’ গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয় ।

 ক্রিপস মিশনে পাকিস্তান সৃষ্টির ইঙ্গিত :

 ১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ কেবিনেট মন্ত্রী স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে সংবিধান সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে ভারতে আসেন । এসব প্রস্তাবের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থার উল্লেখ ছিল । যাহোক ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলেও এর প্রস্তাবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র হতে আলাদা থেকে পৃথক যুক্তরাষ্ট্র গঠনে বিভিন্ন প্রদেশের অধিকার প্রথমবারের মতো স্বীকৃত হয় । এতে পাকিস্তান গঠনের পথে অগ্রগতি হয় ।

 ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা : 

১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-ভারত বিভাগের অনিবার্য পরিস্থিতির সৃষ্টি করে । মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকার গঠন স্থগিত রেখে ১৯৪৬ সালের ২৯ জুন একটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে । ফলে মুসলিম লীগ ব্রিটিশ সরকারকে ওয়াদা ভঙ্গকারী বলে সমালোচনা করে এবং মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা থেকে সম্মতি প্রত্যাহার করে নেয় । কংগ্রেস এ সুযোগে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ।

 এরূপ পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগ ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালনের আহ্বান জানায় । এ দিন লীগ সমগ্র ভারতে হরতাল, বিক্ষোভ ও সভা-সমিতির আয়োজন করে । উক্ত দিনে কলকাতায় মুসলিম লীগ এক বিশাল জনসভার আয়োজন করে। কিন্তু লক্ষ মুসলিম জনতার এ জনসভা কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় হিন্দু জনতার রুদ্ররোষের কারণে পণ্ড হয়ে যায় । শুরু হয় প্রত্যক্ষ দাঙ্গা-হাঙ্গামা ৷ কলকাতা, বিহার, ত্রিপুরা, যুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব এমনকি নোয়াখালীতে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণসহ পৈশাচিক তাণ্ডবে সমগ্র ভারতবর্ষ কেঁপে উঠে ।

এটলির ফেব্রুয়ারি ঘোষণা :

ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় আইন-শৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি ঘটলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সি. আ. এটলি ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে এক বিবৃতি দেন যা ‘ফেব্রুয়ারি ঘোষণা’ নামে পরিচিত। এ বিবৃতিতে ঘোষণা করা হয় যে, বর্তমান অনিশ্চিত পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপদসংকুল । তাই এ পরিস্থিতি আর চলতে দেওয়া যায় না । ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে দায়িত্বশীল ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে ।

ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির পরিকল্পনা : 

নতুন ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভারতে এসে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখতে পান । কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সন্দেহ অবিশ্বাস ও মতানৈক্যের কারণে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা মূলত অচল হয়ে পড়ে । দেশের সর্বত্র সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ভয়াবহ রূপ নেয়। এরূপ পরিস্থিতিতে ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দূর করতে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ব্রিটিশ সরকারের সাথে পরামর্শ করে এক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন ।

১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ সরকারের এক বিবৃতিতে তা প্রকাশিত হয় । এটাই ৩ জুন পরিকল্পনা’ নামে খ্যাত । এ পরিকল্পনায় অবিলম্বে ভারত বিভক্ত করে ‘ভারত ও ‘পাকিস্তান’ এ দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়। এ পরিকল্পনাকে ‘মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনাও’ বলা হয় ।

ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা : 

গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের ১৯৪৭ সালের ৩ জুনের পরিকল্পনার সুপারিশসমূহকে সামনে নিয়ে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের জনগণের স্বাধীনতা প্রদানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় এবং এ আলোকেই ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাস করে। এই আইনানুসারে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে । ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে ভারত নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয় ।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির অপরিহার্যতা প্রসঙ্গ :

 অনেকের মতে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি অপরিহার্য ছিল । এর কারণ হিসেবে তারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনসমূহকে উল্লেখ করেছেন । আবার অনেকের মতে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি অপরিহার্য ছিল না। ভারতীয়দের আন্দোলনের একটি স্রোতধারায় ভারত বিভক্তি সম্পন্ন হয়। প্রকৃত অর্থে বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যায় ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ও সেই সাথে জনগণের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে । তাদের এ আন্দোলন সংগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালের নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি ভারতবর্ষে এক বিক্ষুব্ধ অবস্থার সৃষ্টি করে । এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ বাংলা, পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও অন্যান্য প্রদেশে আইনসভায় নেতৃত্বদানের মতো ক্ষমতা অর্জনে ব্যর্থ হয় ।

উপসংহার :

 পরিশেষে বলা যায় যে, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনচেতা মানুষের সহজা প্রবৃত্তি । ভারতীয়দের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। তবে ভারতীয়রা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থেকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাস অর্জনের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করতে প্রবৃত্ত ছিল । কিন্তু জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব ও লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক স্বতন্ত্র মুসলিম রা গঠনের আন্দোলন ও অন্যদিকে কংগ্রেসের অখণ্ড ভারতনীতি ভারতবর্ষে যে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার সৃি করেছিল তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল ভারত বিভক্তি ।

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related