পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো
ভূমিকা :
১৪ আগস্ট, ১৯৪৭-এর পর ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। গোটা ভারতবর্ষকে ২টি ভাগে বিভক্ত করে পাকিস্তান ও ভারত নামে ২টি নতুন ডোমিনিয়ন বা স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয় । ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে । সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান শুরুতে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে রচিত ভারত শাসন আইনের (১৯৪৭) বিভিন্ন ধারাবলে শাসিত হতে থাকে । মোটামুটি এই আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারা অবলম্বন করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কাঠামো গড়ে উঠে ।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিচয় :
জন্মক্ষণে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ ‘পূর্ব বাংলা’ নামে অভিহিত হয় । ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মারি চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের সকল প্রদেশকে এক ইউনিটে পরিণত করে একে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ নামকরণ করে গণপরিষদে একটি বিল পাস হয় । পাকিস্তানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে প্রদত্ত হলো :
(ক) আয়তন :
সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের মোট ভূখণ্ডের আয়তন ছিল ৩,৬৫,৮২৪ বর্গমাইল ।
(খ) জনসংখ্যা :
১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ কোটি। মোট জনসংখ্যার ৫৬.৩ ভাগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী আর ৪৩.৭ ভাগ নাগরিকের বাস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ।
(গ) ধর্ম ও ভাষা :
পশ্চিমাংশের জনসংখ্যার ৯৭% মুসলিম এবং পূর্বাংশের ৮০% মুসলিম । লোকসংখ্যার ৫৬% ছিল বাংলা ভাষাভাষী ।
১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো : ভারত শাসন আইন ১৯৪৭ দ্বারা পাকিস্তানের আইনগত সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হয় । এটি বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের মর্যাদা লাভ করে । নিম্নে ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো বর্ণনা করা হলো :
কেন্দ্রীয় কাঠামো :
১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কাঠামো নিম্নে প্রদত্ত হলো :
রাজধানী :
পাকিস্তানের প্রথম কেন্দ্রীয় রাজধানী স্থাপিত হয় করাচিতে। এখানেই পাকিস্তানের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে ।
গভর্নর জেনারেল :
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল । পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ‘কায়েদে আজম’ বা মহান নেতা উপাধিতে ভূষিত হন ।
প্রধানমন্ত্রী :
পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন লিয়াকত আলী খান ।
মন্ত্রিসভা :
জাতীয় পরিষদ বা গণপরিষদ থেকেই প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হতো । প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্ট অন্যান্য মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দিতেন ।
গণপরিষদ :
১৯৪৭ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে পাকিস্তান ডোমিনিয়ন গণপরিষদের কাছে নতুন সংবিধান রচনার ক্ষমতার্পণ করা হয় । এ গণপরিষদের মূল কাজ ছিল দুটি। যথা- দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান বা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা এবং কেন্দ্রীয় আইনসভার কার্য সম্পাদন করা। অর্থাৎ সংবিধান চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত দেশের আইন পরিষদরূপেও কাজ করা ।
সংবিধান :
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচিত হয়, যাতে ৩০০ সদস্যের জাতীয় পরিষদ গঠিত হয়। ৭. প্রশাসনিক সদর দপ্তর : সচিবালয়, সুপ্রিম কোর্ট, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর, কেন্দ্ৰীয় – ব্যাংকের হেড অফিস, বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধান কার্যালয় প্রভৃতি সব কিছুই করাচি তথা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করা হয় ।
নিউ ফলা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (আবশ্যিক) নিউ ফর্মুলা প্রাদেশিক কাঠামো ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার কাঠামো নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
প্রদেশ ও রাজ্য :
পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে পাকিস্তানের দুটি অংশ। পূর্বাঞ্চলে ১টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ৪টি প্রদেশ ও ৫টি দেশীয় রাজ্য অবস্থিত ছিল ।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন :
১৯৪৭ সালের ভারত শাসন আইনানুসারে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রদেশসমূহে গভর্নরদের বিশেষ ক্ষমতা বিলুপ্ত করে নিয়মতান্ত্রিক শাসনকর্তারূপে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক তাদের নিয়োগ দেওয়া হয় । তারা ছিলেন প্রদেশে গভর্নর জেনারেলের প্রতিনিধি মাত্র ।
মন্ত্রিসভা :
মন্ত্রিসভা প্রাদেশিক আইন পরিষদের কাছে দায়ী থাকতেন । প্রাদেশিক গভর্নর মন্ত্রিসভার পরামর্শ মোতাবেক কার্যসম্পাদন করতেন । ি
পূর্ব পাকিস্তান :
পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে ১টি প্রদেশ (পূর্ববাংলা) অবস্থিত ছিল। ১৯৫৫ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ববাংলা প্রদেশের রাজধানী ছিল ঢাকা। ৫ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে খাজা নাজিমউদ্দীন সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন । তার নেতৃত্বে ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ পূর্ববাংলার মন্ত্রিসভা গঠিত হয় । পূর্ববাংলার প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হন স্যার ফ্রেডারিক বোর্ন। গভর্নর ভারত শাসন আইন, ১৯৪৭ অনুসারে গভর্নর জেনারেলের মতো প্রশাসনিক কাজ করতেন ।
পশ্চিম পাকিস্তান :
পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ ৪টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত হয় । যথা- (ক) পাঞ্জাব, (খ) সিন্ধু, (গ) উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং (ঘ) বেলুচিস্তান । এছাড়া (ক) বেলুচিস্তান রাজ্য, (খ) ভাওয়ালপুর রাজ্য, (গ) খয়েরপুর রাজ্য, (ঘ) উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ রাজ্য এবং (ঙ) জুনাগড় রাজ্য এই ৫টি দেশীয় রাজ্য পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৫ সালে প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশে রূপান্তরিত করা হয় ।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এর কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার কাঠামো নিয়ন্ত্রিত হয় অবাঙালি ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা। এ নীতি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকে । সৃষ্টির প্রারম্ভে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, সংবিধান ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি প্রভৃতি । জনসংখ্যার দিক থেকে বাঙালিরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ । জনগণের সিংহভাগই ছিল মুসলমান । তবে ধর্ম ছাড়া তাদের মধ্যে ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বেশ অমিল ছিল ।