জাতীয়তার উপাদানসমূহ |
Elements of Nationality
কোনো একটি জনসমাজকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে যেসব উপাদান বিশেষ ভূমিকা পালন করে, সেসবকে জাতীয়তার উপাদান বলা হয়।
রাষ্ট্র দার্শনিকগণ জাতীয়তার যেসব উপাদানের কথা বলেছেন, তন্মধ্যে উল্লেখ
উপাদানগুলো হলো-
১ . বংশগত ঐক্য : যদি একটি জনসমাজের অধিকাংশ লোক একই বংশজাত বলে নিজেদের মনে করে, তবে তাদের মধ্যে এক প্রবল জাতীয় ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়, যা তাদেরকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে।
কিন্তু বর্তমানকালে এ বিষয়টি খুব বেশি প্রভাব রাখতে পারে না। কেননা কোনো বংশ আজ অবিমিশ্রভাবে পাওয়া সম্ভব নয়।
অস্ট্রিয়ার জনগণ এরূপ একই বংশজাত বলে নিজেদেরকে দাবি করলেও নৃতাত্ত্বিকভাবে এর প্রমাণ মেলেনি।
২।ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্য : জাতীয়তাবোধের অন্যতম উপাদান হলো ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি।
যখন কোনো জনসমাজের অধিকাংশ লোকের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি একই হয়, তখন তাদের মধ্যে এক সহজাত জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে পারি। এ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল একই ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি ঐক্য থাকার ফলে।
ভাষা আন্দোলন পরবর্তীতে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। জার্মান দার্শনিক ফিক্টে মনে করতেন, জাতি গঠনের অন্যতম উপাদান সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্য।
একই সাহিত্য ও সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি করতে পারে।
তবে একথাও সত্য, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিগত ঐক্য জাতীয়তাবোধের খুব শক্তিশালী উপাদান নয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা ভারতের কথা বলতে পারি।
সেখানে একাধিক রাষ্ট্রীয় ভাষা ও একাধিক সংস্কৃতির মানুষ থাকলেও তাদের জাতীয়তাবোধে এ উপাদানটি কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি।
আরেকটি উদাহরণ আমরা উল্লেখ করতে পারি— যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিক প্রভৃতি দেশের ভাষা ইংরেজি হলেও তারা ভিন্ন ভিন্ন জাতি।
কাজেই ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিগত ঐক্য জাতীয়তার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও আবশ্যক উপাদান নয়।
৩।ধর্মীয় ঐক্য : প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্মই জাতি গঠনের অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতো।
গিলক্রিস্টের মতে, “ধর্মবিশ্বাসের প্রবল পার্থক্যের কারণে জাতিগত ঐক্য ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য হয়।”
১৯৪৭ সালে ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতেই ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়। তবে বর্তমানে ধর্মের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। ধর্মীয় ঐক্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষা করতে পারেনি।
চীন, ভারত বহু ধর্মের সমষ্টিতে জাতি গঠন করলেও এক ধর্মের অনুসারীরা এক জাতি গঠন করতে পারেনি অনেক ক্ষেত্রেই ।
৪।ভৌগোলিক ঐক্য : এটি জাতীয়তাবোধের অন্যতম এক উপাদান। নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারীরা খুব সহজেই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে পারে।
জাতি গঠনের অন্যান্য উপাদান থাকলেও কেবল ভৌগোলিক নির্দিষ্ট ভূখণ্ড না থাকায় ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত কোনো জাতি গঠন করতে পারেনি।
আবার একই ভূখণ্ডের মধ্যে বসবাস করে অন্যান্য উপাদানে মিল থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশ বিচ্ছিন্ন জাতি গঠন করে থাকে।
৫. ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ঐক্য : যখন কোনো অঞ্চলে দীর্ঘদিন থেকে বসবাসকারী জনসাধারণের মধ্যে এক স্বাভাবিক ঐক্যবোধ দেখা যায়, তখন তাদের মধ্যে এ ঐক্য জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করতে পারে।
প্রত্যেক জাতির অতীত স্মৃতি ও ঐতিহ্য তাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। এ অনুপ্রেরণা জাতীয়তা গঠনে ভূমিকা পালন করে।
বার্নাস-এর মতে, “বংশগত ঐক্যের চেয়ে অভিন্ন স্মৃতি ও ধ্যানধারণার উত্তরাধিকার জাতীয়তা গঠনের জন্য অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।”
৬. মনস্তাত্ত্বিক ঐক্য : জাতীয়তা গঠনের ক্ষেত্রে এ মনস্তাত্ত্বিক ঐক্য অনেক শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। অধ্যাপক গেটেল বলেন, “আধুনিক রাষ্ট্রের ঐক্যের ভিত্তি বাহ্যিক নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক।”
রেনান জাতীয়তাকে ‘ভাবগত’ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেন। অধ্যাপক স্পেঙ্গলার (Prof. Spenglar) বলেন, “জাতীয়তার উপাদান বংশগত বা ভাষাগত ঐক্য নয়, বরং এটি ভাবগত ঐক্য।”
ফরাসি অধ্যাপক রেনান বলেন, “জাতীয়তা আসলে একটি ভাবগত ধারণা।”
অধিকাংশ রাষ্ট্র দার্শনিক মনে করেন, একই বংশ, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভৌগোলিক এলাকা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্বার্থ জাতীয়তা গঠনে সাহায্য করে মাত্র।
কিন্তু এগুলোর কোনোটি এককভাবে জাতীয়তা গঠনে অপরিহার্য নয়। কেননা এদের যেকোনো একটি বা কয়েকটি বাদ দিলেও জাতীয়তা গঠিত হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তা গঠনে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক উপাদান হলো মনস্তাত্ত্বিক বা ভাবগত ঐক্য।
৭. রাজনৈতিক ঐক্য : যারা একই ধরনের রাজনৈতিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকে দীর্ঘদিন, তাদের মধ্যে স্বভাবগত এক ঐক্যবোধের সৃষ্টি হয়।
এক্ষেত্রে জাতীয়তার অন্যান্য উপাদান কোনো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে না। যেমন- গ্রেট ব্রিটেনের অঙ্গরাজ্যগুলো একই জাতীয়তাবোধে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছে রাজনৈতিক ঐক্যের কল্যাণে।
৮. আচরণ ও রীতিনীতিগত ঐক্য : এটি জাতীয়তার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একটি জনসমষ্টির মধ্যে একই ধরনের আচার-আচরণ, রীতিনীতি ও ঐতিহ্য গড়ে উঠলে তারা নিজেদেরকে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে চিন্তা করতে থাকে।
এ কারণেই পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক বাংলাদেশ গঠন করতে পেরেছিল।
৯. অর্থনৈতিক ঐক্য : কোনো জনসাধারণ যদি একই অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধনে যুক্ত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়, তবে তা একসময় জাতীয়তাবোধ জাগায়।
৫০টি আলাদা অঙ্গরাজ্য অর্থনৈতিক ঐক্যের ভিত্তিতে একত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠন করেছে এবং একটি শক্তিশালী জাতি গঠন করেছে।
তবে এটি জাতীয়তা গঠনে আবশ্যক উপাদান নয়। পরস্পর স্বার্থবিরোধী পক্ষও একই জাতিরাষ্ট্রে বসবাস করে থাকে।
১০. সমস্বার্থ : সমস্বার্থ জাতীয়তা গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কারণ সমস্বার্থ বা একই ধরনের স্বার্থ জনগণের মাঝে ঐক্যবোধ গড়ে তুলতে পারে।
আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায়, জাতীয়তা গঠনে সব উপাদান সবসময় সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়।
স্থান, কাল ও পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে এক একটি উপাদান কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে ।