পাঠ-৭.৬ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায় সমূহ:

পাঠ-৭.৬ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়
Way to Continue of Freedom of Judiciary

আধুনিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের সুনাম ও পারদর্শিতার উপর একটি সরকারের অবস্থান ও স্থায়িত্ব অনেকাংশে নির্ভর করে।

ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার প্রশ্নটি জরুরি হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় জীবনে ন্যায়নীতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।

নিচে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার কতিপয় উপায় উপস্থাপন করা হলো-

১।বিচারকদের নিয়োগ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কর্মদক্ষতা বিচারকদের যোগ্যতার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল ।

তাই তারা কীভাবে নিয়োগ লাভ করেন সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

যথা- আইনসভা কর্তৃক নির্বাচন, জনগণ কর্তৃক নির্বাচন এবং প্রধান নির্বাহী কর্তৃক নির্বাচন। বিচারকদের নিয়োগের এ তিনটি পদ্ধতি নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।

আইনসভা কর্তৃক নির্বাচিত বিচারকগণ আইনসভার কাছে দায়ী থাকেন। তা ছাড়া এই পদ্ধতিতে দলীয় ব্যক্তির নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফলে মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ কমে যায়।

জনগণ কর্তৃক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও জনভাবাবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে কিংবা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে অযোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এ অসুবিধা দূর করার জন্য বর্তমানে অধিকাংশ রাষ্ট্রেই প্রধান নির্বাহী কর্তৃক বিচারক নিয়োগের পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে।

তবে এতেও রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় প্রধান নির্বাহী বিচারকমণ্ডলী এবং বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির সুপারিশক্রমে বিচারকদের নিয়োগ দান করেন।
বর্তমানে এটিই সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য নিয়োগপদ্ধতি ।

২। বিচারকদের কার্যকাল : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করার জন্য বিচারপতিদের কার্যকালের স্থায়িত্ববিধান প্রয়োজন।

অর্থাৎ, বিচারকগণ একবার নিযুক্ত হলে তাদের চাকরির কার্যকাল একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নির্ধারণ করা উচিত। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Alan Ball-এর মত, বিচারপতিদের কার্যকালের নিরাপত্তা তাদের স্বাধীনতা সংরক্ষণের হাতিয়ার।

কার্যকালের স্থায়িত্ব থাকলে বিচারকগণ নির্ভীক ও নিঃসংশয় চিত্তে সততার সাথে বিচারকার্য সম্পাদন করতে উৎসাহী ও তৎপর থাকবেন।

কোনো ধরনের গুরুতর অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত না থাকলে তাদের অপসারণ করা উচিত নয়। সাংবিধানিক বিশেষ বিধানের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণ করা যুক্তিসংগত।

মোটকথা, বিচারকগণের চাকরির নিশ্চয়তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ।

৩। বিচারকগণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য : বিচারকগণের নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অনেকাংশে নির্ভর করে।

এ জন্য বিচারকদের অবশ্যই আইনজ্ঞ, দৃঢ় মনোবলের অধিকারী, নির্ভীক ও স্বাধীনচেতা হতে হবে।

৪। বিচারকদের পদোন্নতি : বিচারকদের কার্যক্ষমতা নির্ভর করে তাদের কার্যসম্পাদনের উপর।

এ কর্মসম্পাদনের ইচ্ছা আবার অনেকাংশে নির্ভর করে পদোন্নতির আশার উপর। সাধারণত জ্যেষ্ঠত্ব নীতি অনুসারেই পদোন্নতি হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বিচারকদের পদোন্নতির বিষয়টি অতি যত্নের সাথে বিবেচনা করা উচিত। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে কৃতিত্ব ও মেধার উপর ভিত্তি করেও তাদের পদোন্নতি দেওয়া যেতে পারে।

৫। অপসারণপদ্ধতি : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে সংবিধান বর্ণিত অভিযোগ ব্যতীত শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ কিংবা জনগণের হাতে এককভাবে খেয়াল-খুশিমতো বিচারকদের অপসারণ করার ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।

৬। উপযুক্ত বেতন-ভাতা : বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য বিচারকদের উচ্চ বেতন-ভাতার সুব্যবস্থা এবং অবসরজনিত ভাতার সুব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য।

অর্থের অভাবে সামাজিক মর্যাদা থেকে বিচারকগণ বঞ্চিত হলে মানসিক অশান্তিতে ভুগতে পারেন, যার ফলে বিচারকগণের নিরপেক্ষ বিচারকার্যে বাধার সৃষ্টি হবে।

বেতন- ভাতার সুব্যবস্থা থাকলে বিচারকগণ সৎ ও নির্লোভ থাকবেন এবং ভবিষ্যতে সৎ ও মেধাবী আইনজ্ঞগণ বিচারক পদে প্রবেশ করতে আগ্রহী হবেন।

৭। সামাজিক মর্যাদা : বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর সামাজিক পদমর্যাদার বিষয়টি নির্ভর করে।

তাই সামাজিকভাবে বিচারকদের অবস্থান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৮। বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য্য ও প্রাধান্য : ক্ষমতা পৃথকীকরণ বা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মাধমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে।

অর্থাৎ বিচার বিভাগকে আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে লাস্কি বলেন, স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য অত্যাবশ্যক।

তাছাড়া সাংবিধানিক উপায়ে এ বিভাগের প্রাধান্যও প্রতিষ্ঠা করা উচিত ।

৯। প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ প্রদান : দক্ষ বিচারিক কার্য সম্পাদনের জন্য বিচারকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ দিতে হবে।

এতে একদিকে তারা যোগ্যতা ও দক্ষতার উৎকর্ষ সাধন করতে পারবেন, অন্যদিকে আর্থিকভাবেও লাভবান হবেন।

১০। বিচারকদের নিরাপত্তাব্যবস্থা : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বিচারকদের পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।

কারণ নিরাপত্তার অভাবে অনেক সময় বিচারকগণ ন্যায্য রায় প্রদান করতে ব্যর্থ হন। মোটকথা, বিচারকের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার একটি অন্যতম শর্ত।

১১। জনগণ ও রাজনীতিবিদদের আগ্রহ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জনগণ ও রাজনীতিবিদদের আগ্রহ থাকতে হবে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনবোধে জনগণকে শাসনতান্ত্রিক উপায়ে চাপ প্রয়োগ ও আন্দোলন করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে দেশের জনগণের ও রাজনীতিবিদদের সচেতনতা জরুরি।

১২। লিখিত সংবিধান : সংবিধান হলো যেকোনো রাষ্ট্রের মৌলিক আইন, যা রাষ্ট্রের শাসনপ্রণালি নির্ধারণ করে থাকে। বিচারকগণ লিখিত সংবিধানের ধারা অনুযায়ী রায় দিলে জনগণের মধ্যে রায় সম্পর্কে থাকবে না।

তাই লিখিত সংবিধানও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাথে সম্পৃক্ত।

১৩। আইন ও সাংবিধানিক বিষয় : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য আইন ও সাংবিধানিক ব্যাপারে
বিচারকদের কর্তৃত্ব থাকতে হবে।

১৪। সরকারি কাজে নিয়োগ না করা : বিচারকগণ চাকরিতে থাকা অবস্থায় বা অবসরকালে কোনো সরকারি পদে নিয়োগ দেওয়া উচিত নয়।

কেননা, অবসরকালে চাকরি পাওয়ার আশায় তারা সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছে আনুগত্য স্বীকার করবেন। ফলে নিরপেক্ষ বিচারকার্যে ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা থাকে।

১৫। ডব্লিউ. এফ. উইলোবির অভিমত : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কর্মদক্ষতা অর্জনের জন্য প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডব্লিউ. এফ. উইলোবি তিনটি প্রধান শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন।

যথা :
(ক) বিচারের জন্য অপরাধীদের তাদের সম্মুখে আনয়ন করার অধিকার বিচারপতিদের থাকতে হবে।

(খ) আদালতের যাবতীয় বিষয়ের গুরুত্ব যাতে বিচারকগণ জনসাধারণকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হন, তার সুযোগ
থাকতে হবে।

(গ) বিচারপতিদের আদেশ ও রায় কার্যকর করার পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করা আবশ্যক ।