সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের করণীয় :
Role of Government in Establishing Good Governance:
যেকোনো রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
সরকার রাষ্ট্রের অভিভাবক ও পরিচালক হিসেবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
সরকার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলে, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে।
রাষ্ট্র প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, জনগণের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকে।
নিচে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ আলোচনা করা হলো :
১। ই-গভর্ন্যান্স চালু করা : সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার হলো ই-গভর্ন্যান্স।
বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যেকোনো সরকারই রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ই-গভর্ন্যান্স চালুর ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
ই- গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে সরকার ও নাগরিকগণের মধ্যে যোগাযোগ দ্রুত ও সহজতর হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারি কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পায়।
২। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যেকোনো সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে নাগরিকগণের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়।
সরকারকে আইন অনুযায়ী শাসন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
৩। জবাবদিহিমূলক প্রশাসনব্যবস্থা : দায়িত্বশীল প্রশাসন সরকারের যাবতীয় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট থাকে।
দক্ষ প্রশাসনব্যবস্থা সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধের কাজ করে থাকে। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলতে আন্তরিক হতে হবে।
৪। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার উপভোগের ক্ষেত্রকে প্রসারিত ও সুরক্ষিত করে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারকে তৎপর হতে হবে। বিচারকদের নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়ে দলীয় প্রভাব বিস্তার রোধ করতে হবে।
এছাড়া মামলা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ ও বিচার বিভাগের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি উদ্যোগের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রসারিত করা যায়।
৫। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকলে সরকারের কার্যক্রমের ভালো-মন্দ দিকগুলো যথাযথভাবে সরকার ও জনগণের দৃষ্টিগোচর হয়।
জনগণের চাহিদা, অভাব-অভিযোগ সরকারের কাছে পৌঁছতে পারে এবং সরকার সে অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
সরকারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমগুলোকে অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগ প্রদান করলে গণমাধ্যম দায়িত্বশীল, গতিশীল, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তথ্য প্রচার করতে পারে।
গণতান্ত্রিক সরকার “গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না।
৬। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা : অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
দক্ষ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখে।
নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাই মুখ্য।
৭। নারীর ক্ষমতায়ন : রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন জরুরি।
সরকারের নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
এক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য নিরসনে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৮। দুর্নীতি দূরীকরণ : সুশাসনের পূর্বশর্ত হচ্ছে সরকার ও জনজীবনে দুর্নীতি হ্রাস করা। দুর্নীতি সুশাসনের পথে
অন্যতম বাধাস্বরূপ।
সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা দুর্নীতি দূরীকরণে বলিষ্ঠ ও কার্যকর ভূমিকা রাখে।
এ ক্ষেত্রে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন, দুর্নীতিবিরোধী কঠোর আইন প্রণয়ন ও রাষ্ট্রীয় আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
৯। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি গ্রহণ : কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসহায় ও দুস্থ মানুষের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের বিষয়টি গুরুত্ব পায়।
বর্তমানে সব রাষ্ট্রেই অসহায় ও দুস্থ মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
তাই সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হলো সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির বাস্তবায়নে আন্তরিক হওয়া।
সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির আওতায় নিম্নোক্ত বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত :
(ক) বিভিন্ন সমবায় সমিতি গঠন;
(খ) ভূমিহীন, দরিদ্র কৃষকদের কৃষিঋণ ও আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করা;
(গ) নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান;
(ঘ) তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা।
১০। মানব উন্নয়ন : সুশাসন মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করে।
মানব উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে সরকারকে গণমুখী ও কল্যাণমুখী নীতি গ্রহণ করতে হবে।
মানব উন্নয়নের জন্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সুশীলসমাজ ও ব্যক্তিগত খাতকে উন্নয়নে সম্পৃক্ত
করতে হবে।
১১। দাতাগোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতাগোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীলতা সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করে।
দাতাগোষ্ঠীর চাপে এসব দেশ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে না।
দাতাগোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য সরকারকেই কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও উদ্যোগী হতে হয়।
সরকারকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
নিজস্ব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে।
১২। শিক্ষার উন্নয়ন : শিক্ষা সব উন্নয়নের চাবিকাঠি। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সুশাসন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে
এবং গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে।
তাই সরকারকে সব শ্রেণির মানুষের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, বাস্তবভিত্তিক ও কর্মমুখী হিসেবে গড়ে তুলতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১৩। শিল্পোন্নয়ন : রাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন শিল্পোন্নয়নের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
শিল্প উন্নয়নে শিল্প উদ্যোক্তা তৈরি, বিনিয়োগ প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ব্যবসায় শিক্ষার প্রসার, কাঁচামালের জোগান ইত্যাদি বিষয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা দরকার।
বিনিয়োগকারীরা দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উৎপাদনমুখী বিনিয়োগে এগিয়ে আসে না।
এ বিষয়ে সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করে শিল্পোন্নয়ন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।