প্রশ্ন : ৬.২। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি ব্যাখ্যা কর ৷অথবা, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা কর।অথবা, ছয় দফা কি? ছয় দফার কর্মসূচিগুলো আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে আইয়ুব সরকারের বিরোধীদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ কাঠামো ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এটাই ঐতিহাসিক ‘৬ দফা কর্মসূচি’।

এ ৬ দফাই পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এতে বাঙালির আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও বাঁচার মুক্তিসনদরূপে আখ্যায়িত হয়। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এটা ছিল মারণাস্ত্রস্বরূপ।

আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচি : নিম্নে আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচির বিবরণ দেওয়া হলো :

১. প্রথম দফা- শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন রূপে গড়তে হবে। তাতে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে, সকল নির্বাচন সর্বজনীন ও প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভার সার্বভৌমত্ব থাকবে।

বিশ্লেষণ : লাহোর প্রস্তাব ছিল ব্রিটিশ ভারতে পাকিস্তানের মুসলমানদের প্রাণের দাবি। মূলত লাহোর প্রস্তাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেসব বিধান উল্লেখ ছিল তার ভিত্তিতে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের মুসলমানগণ রায় দিয়েছিল।
আবার ১৯৫৪ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের মূলে ছিল এই লাহোর প্রস্তাব। সুতরাং শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার প্রথম দফায় যে প্রস্তাব করেছেন তা নতুন কোনো প্রস্তাব ছিল না, যা পাক-বাহিনীর মনঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সুতরাং সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা, সর্বজনীন ভোটাধিকার ও সার্বভৌম আইন পরিষদ এই ছিল প্রথম দফার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।

২. দ্বিতীয় দফা-কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা : ফেডারেল সরকারের হাতে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র এ দুটি বিষয়ের ক্ষমতা থাকবে। অবশিষ্ট ক্ষমতা প্রদেশসমূহের হাতে থাকবে।

বিশ্লেষণ : এই দফা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা আর পররাষ্ট্র সংক্রান্ত ক্ষমতা দিয়ে এক অর্থে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকেই তুলে ধরা হয়েছে।

এ দফা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বলেছেন,
“এ প্রস্তাবের জন্যই কায়েমি স্বার্থের দালালরা আমার উপর সর্বাপেক্ষা বেশি চটেছেন। আমি নাকি পাকিস্তানকে দুই টুকরা করতে ধ্বংস করার প্রস্তাব দিয়েছি।”

৩. তৃতীয় দফা-মুদ্রা ও অর্থ সম্বন্ধীয় ক্ষমতা : এ দফায় মুদ্রা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব ছিল এবং এদের মধ্যে যেকোনো একটি গ্রহণের দাবি করা হয়।

(ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করতে হবে এবং দুই অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে।

(খ) দু’অঞ্চলের বা সারা দেশের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। কিন্তু শাসনতন্ত্রে এমন এক সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার না হতে পারে। এ বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দু অঞ্চলের জন্য দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।

বিশ্লেষণ : তৃতীয় দফার বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, আমার প্রস্তাবের মর্ম এই যে, উপরিউক্ত দুটি বিকল্পের দ্বিতীয়টি গৃহীত হলে মুদ্রা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে থাকবে। যে অবস্থায় উভয় অঞ্চলের একই নকশার মুদ্রা বর্তমানে যেমন আছে তেমন থাকবে।

পার্থক্য শুধু এই যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ইস্যু করা হবে এবং তাতে পূর্ব পাকিস্তান বা সংক্ষেপে ঢাকা লেখা থাকবে। তদ্রূপ পশ্চিম পাকিস্তানেও থাকবে। মূলত এই মুদ্রা ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানকে নিশ্চিত অর্থনৈতিক মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করাই উদ্দেশ্য ছিল ।

৪. চতুর্থ দফা- রাজস্ব কর ও শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা : সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ও কর ধার্য এবং আদায়ের ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে এবং আদায়যোগ্য অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ ফেডারেল তহবিলে জমা হবে।

বিশ্লেষণ : ৬ দফার প্রণেতাগণ মনে করেন যে, এ দফার সুবিধা অনেক। যেমন-

(ক) কেন্দ্রীয় সরকারকে কর আদায়ের কোনো ঝামেলা পোহাতে হবে না।

(খ) কর ধার্য ও আদায়ের জন্য কোনো দফতর বা কর্মকর্তার প্রয়োজন হবে না।

(গ) কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যগুলোর জন্য কর ধার্য ও আদায়ের মধ্যে কোনোরূপ দ্বৈততা থাকবে না। এতে অপচয় ও অপব্যয় রোধ হবে ।

(ঘ) এর ফলে ধার্য ও আদায়ের একত্রীকরণ সহজ হবে।

৫. পঞ্চম দফা-বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা : এ দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিম্নলিখিত শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হয় :

(ক) দু’অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখতে হবে।

(খ) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে ।

(গ) ফেডারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুটি অঞ্চল থেকে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্র নির্ধারিত হারে আদায় হবে।

(ঘ) দেশীয় দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রফতানি করা চলবে।

(ঙ) ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্ক, বিদেশের সাথে চুক্তি সম্পাদন, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন এবং আমদানি-রপ্তানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করে শাসনতান্ত্রিক বিধান করতে হবে।

বিশ্লেষণ : পঞ্চম দফার যৌক্তিকতা সম্পর্কে ৬ দফার প্রবক্তাগণ বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গড়ে না উঠায় পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশি মুদ্রা ব্যবহারে ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের নেই, এ অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হচ্ছে। ফলে পূর্ব পাকিস্তান অনুন্নতই থেকে যায় ।

৬. ষষ্ঠ দফা-আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা : অঙ্গরাজ্যগুলোর আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সংহতি রক্ষার জন্য সংবিধানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারি (আধা সামরিক) বাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে ।

বিশ্লেষণ : ষষ্ঠ দফার যৌক্তিকতা সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বলেন এ দাবি অন্যায়ও নয় নতুনও নয়। কারণ যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবির মধ্যে আনসার বাহিনীকে ইউনিফর্মধারী সশস্ত্র বাহিনীতে রূপান্তরিত করার দাবি করা হয়েছিল।

উপসংহার : সুতরাং উপরিউক্ত কর্মসূচিগুলো ছিল ৬ দফার অন্তর্ভুক্ত যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই বলা যায় যে, ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রের ইতিহাসে যেমন ম্যাগনাকার্টা, ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে অধিকার বিল, আমেরিকার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতার বাণী এবং রুশ বিপ্লবের ভিত্তিতে যেমন ছিল শ্রেণীহীন সমাজের ধারণা তেমনি বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের নির্বাচন ও স্বাধীনতার আন্দোলনে ঐতিহাসিক ৬ দফা ছিল এক মাইলফলক। তাই তো ৬ দফাকে বাঙালির মুক্তিসনদ বলা হয়। কারণ ৬ দফা আন্দোলনের উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জনগণ স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা করে। এ আন্দোলনের স্মৃতি ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামে বাঙালিদের আত্মোৎসর্গে সাহস ও উদ্দীপনা যোগায় ।