প্রশ্ন : ৮.৫। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এবং এর প্রভাব আলোচনা কর ৷অথবা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের বিষয়বস্তু ও গুরুত্ব আলোচনা কর ৷

৭ মার্চের ভাষণ এবং এর প্রভাব আলোচনা

উত্তর : ভূমিকা বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে দীর্ঘপথ পরিক্রমায় ১৯৭০ সালের ৭ মার্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। সে অর্থে রেসকোর্স ময়দানে (যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত) একটি সমভাবে উচ্চারিত নাম। সেদিন এ ময়দানেই এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল এবং দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক শাসকচক্রের বিরুদ্ধে এক চরম হুঁশিয়ারি বাণী।

বাঙালি জাতির মুক্তির দিক-নির্দেশনা এদিন ঘোষিত হয় অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসী কণ্ঠে। কেঁপে উঠে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মসনদ। ঐতিহাসিক এ দিক-নিদের্শনামূলক ভাষণের প্রভাব বাংলার ইতিহাসে হয়েছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। গোটা বিশ্ব ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণসমূহের মধ্যে অন্যতম তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি।

৭ মার্চের ভাষণ : রেসকোর্স ময়দানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের শুরুতেই শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, “আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভায়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার পেতে চায়।

কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পর বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণরূপে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সাথে বলতে হয় ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস।

২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস, নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।”

শেখ মুজিব তার ভাষণে আরো বলেন, “১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে? আমরা গদিতে বসতে পারি নি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর বর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে ৭ জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন- গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম —

শুধু তাই নয় উক্ত জনসভায় শেখ মুজিব ভুট্টোর প্রতি প্রেসিডেন্টের নিলজ্জ পক্ষপাতিত্বের কথাসহ উপস্থিত জনতার সামনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কি হবে এবং জনগণের কর্তব্য বা করণীয়ই বা কি হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করেন । তিনি প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলার জন্য অনুরোধ করেন।

জনসাধারণের অসুবিধা বিবেচনায় তিনি কয়েকটি জনগুরুত্বপূর্ণ ও সেবাখাতে অসহযোগ আন্দোলনের শিথিলতার কথাও ঘোষণা করেন। তিনি সবাইকে হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেন। বঙ্গবন্ধু সর্বশেষ বলেন, “মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তিনি জনগণকে তাদের আন্দোলন অব্যাহত এবং তার পাশাপাশি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এক উদাত্ত আহ্বান জানান ।

৭ মার্চের ভাষণের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া : আবেগতাড়িত লাখো জনতার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া হয়েছিল অত্যন্ত ত্বড়িতগতিতে। মুজিবের নির্দেশ অনুসারে ৮ মার্চ থেকে পুনরায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় এবং সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন আওয়ামী লীগের হাতে চলে আসে।

তাজউদ্দীন আহমদ এ অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচির এক বিস্তৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করেন। জনগণ সে কর্মসূচি মেনে চলতে থাকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত। সেদিনই পি. ডি. পি নেতা নূরুল আমীন এক বিবৃতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে শেখ মুজিবের সাথে আলোচনায় বসার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অকস্মাৎ স্থগিত ঘোষণার ফলেই এ গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। অথচ এ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনই ছিল নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রথম পর্যায় ৷

এদিকে মওলানা ভাসানীও গর্জে উঠেন এবং শেখ মুজিবের আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন করে তার নির্দেশ মেনে চলার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খানও শেখ মুজিবকে জাতীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানান।

অবশেষে আসে করাচির ৭ জন আওয়ামী লীগ নেতার বিবৃতি। তারা সকলেই অবিলম্বে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের আবেদন জানান। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে এবং তার স্থলে আওয়ামী লীগের নির্দেশনামা স্থানলাভ করে।

দেশে সৃষ্টি হয় এক জটিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট। শাসকগোষ্ঠীর শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে বিরাজমান পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয় নি; বরং তাতে বাঙালিদের আইন অমান্য আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে উঠে। শাসকগোষ্ঠী শক্ত হস্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে । যার ফলশ্রুতি ২৫ মার্চের কালরাত্রি।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণ ও দমননীতির প্রতিবাদের ধারাবাহিকতারই বাস্তব ফলশ্রুতি ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্বালাময়ী ভাষণ । স্বাধীনতার পর তার ঐ বক্তৃতার মূল্যায়নে প্রমাণিত হয়েছে যে, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ ৭ মার্চের ভাষণটিই । এ ভাষণকে তাই গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সাথে তুলনা করা যায় অনেকটাই । বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের আবেদন তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related

৫ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট পাবেন সকল গ্রাহক কিভাবে নিবেন? 5 GB free internet all sim| How to take 5 GB internet free 2024...

৫ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট পাবেন সকল গ্রাহক: কিভাবে নিবেন?বাংলাদেশের...

সপ্তম / ৭ম শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি গাইড pdf গাইড ডাউনলোড ২০২৫| Class 7 Art & Culture Guide 2025

ভূমিকা: ৭ম শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি গাইড PDF ডাউনলোড...