১.৭ হিব্রু সভ্যতা কি বা কাকে বলে?

১.৭ হিব্রু সভ্যতা |
The Hebrew Civilization

সভ্যতার ইতিহাসে হিব্রু সভ্যতা অত্যন্ত তাৎপর্যময়।

পিরামিড, প্রশাসন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাস্তাঘাট বা দালান-কোঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মৌলিক কৃতিত্বের ছাপ না রেখেও তারা সবকিছু ছাপিয়ে ধর্মক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

এ সভ্যতায় বর্তমান বিশ্ববাসীর ঐতিহাসিক ধর্মীয় আবেগ রয়েছে। ইসলাম, খ্রিষ্টান, ইহুদি এ তিন ধর্মের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে হিব্রু সভ্যতা জড়িত রয়েছে।

স্টুয়ার্ড মি. ইস্টান বলেন, “Both Christianity and Islam have adapted a considerable portion of the Hebrew religious insights as their own.”

হিব্রু জাতির উৎপত্তি :   হিব্রু একটি সেমিটিক ভাষা।

এ হিব্রু ভাষাভাষীরা ইতিহাসে হিব্রু জাতি নামে পরিচিত। হিব্রু একটি ব্যাবিলনীয় শব্দ।

এর অর্থ বিদেশি নিঃবংশীয় যাযাবর। এ শব্দটির হিব্রু ভাষার সমশব্দ হচ্ছে ইবিরি (Ibri)। এটি আরবি শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ অতিক্রম করা।

এ থেকে মনে হয়, তারা যাযাবর জাতি অর্থাৎ অন্য কোনো স্থান হতে এসে বসতি স্থাপন করেছে।

অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, হিব্রুদের আদিবাস ছিল আরব মরুভূমি।

কারও কারও মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে কেনানাইট আরব (যারা ছিল নূহ (আ.)-এর পুত্র কেনানের বংশধর) প্যালেস্টাইনে বসতি স্থাপন করে।

কেউ কেউ মনে করে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দে ইব্রাহিমের নেতৃত্বে হিব্রুদের একটি দল এখানে বসতি গড়ে তোলে।

ইহুদিরা যে প্যালেস্টাইনের আদি বাসিন্দা নয়, তা বাইবেলের আদিগ্রন্থ Old Testament থেকে বোঝা যায়।

হিব্রু সভ্যতার ভৌগোলিক অবস্থান :   বর্তমান জেরুজালেম নগরীকে কেন্দ্র করে প্রাচীন হিব্রু সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়েছিল।

এ সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত প্যালেস্টাইনের অবস্থান এশিয়া মহাদেশের পশ্চিমে।

দেশটির উত্তরে রয়েছে প্রাচীন ফিনিশিয়া আর বর্তমান লেবানন। এর দক্ষিণে সৌদি আরব, পূর্বে জর্ডান এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর ।

রাজনৈতিক ইতিহাস :   প্যালেস্টাইনের জেরুজালেম নগরীকে কেন্দ্র করে হিব্রু সভ্যতা গড়ে ওঠে।

এ সভ্যতার জনগণ হিব্রু বা ইহুদি নামে পরিচিত। তারা প্রথমে সুমেরীয়দের অধীনে ছিল।

তাদের নেতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) বা আবরাহাম ১৮০০ . খ্রিষ্টপূর্বে তার অনুসারীদের নিয়ে উত্তর-পশ্চিম মেসোপটেমিয়ায় চলে যান।

পরবর্তীতে আবরাহামের বংশধর ইয়াকুব (আ.) বা জ্যাকব হিব্রুদের নিয়ে প্যালেস্টাইনের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন ।

ইয়াকুব (আ.)-এর আরেক নাম ছিল ইসরাইল। সেই সূত্রে তার অনুসারীরা ইসরাইলি নামে পরিচিত।

হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর ১২ পুত্রের একজনের নাম ছিল জুদা বা ইয়াহুদা। এই ইয়াহুদার নামানুসারে এ বংশের নামকরণ করা হয় ইহুদি।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ অব্দে হিব্রুরা মিশরের ফারাও সম্রাটদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়।

পরবর্তীতে ১৩০০-১২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হযরত মুসা (আ.) বা মোজেস-এর নেতৃত্বে তারা দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে সিনাই উপদ্বীপে এসে নতুন বসতি গড়ে তোলে।

হযরত মুসা (আ.) তাদের একেশ্বরবাদী নিজেকে জেহোভার (Jehovah) উপাসনায় আকৃষ্ট করেন।

কিন্তু মুসা (আ.)-এর মৃত্যুর পর পুনরায় তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ডেভিড বা হযরত দাউদ (আ.) হিব্রুদের সংঘটিত করে ত্রিশ বছর বয়স থেকে একটানা ৪০ বছর রাজত্ব করেন।

তার রাজত্বকাল অত্যন্ত গৌরবময়। তিনি হিব্রুদের দশটি গোত্রকে একত্রিত করে একটি মহান জাতিতে পরিণত করেন।

প্যালেস্টাইন, ফিলিশীয়া, আরামাইনসহ দক্ষিণ সিরিয়া তার সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

জেরুজালেম রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। দাউদ (আ.) একজন দক্ষ শাসক ছিলেন।

তার মৃত্যুর পর সলোমন বা হযরত সোলায়মান (আ.) হিব্রু জাতির নেতৃত্ব লাভ করেন ।

সলোমনের রাজত্বকালে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে চরম সমৃদ্ধি লাভ করে।

কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি তিনি সাম্রাজ্যকে ১২টি প্রদেশে বিভক্ত করেন।

প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তিনি সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।

তিনি জেরুজালেমে বায়তুল মুকাদ্দাস (মসজিদুল আল আকসা) নির্মাণ করেন।

৫৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ক্যালডীয় রাজা নেবুচাদনেজারের জুডাহ অধিকারের মধ্য দিয়ে হিব্রু সভ্যতার পতন ঘটে।

হিব্রুদের ধর্ম : পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম হিব্রুরা একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রবর্তনে সক্ষম হয়।

ওল্ড টেস্টামেন্ট (Old Testament) ইসলামের ভাষায় তৌরাত তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম।

পবিত্র কুরআন শরিফের বর্ণনায় হযরত দাউদ (আ.)-এর সম্পর্কে অনেক তথ্য দেখা যায়।

হিব্রুদের মধ্যে জাদুটোনা, জেহোবা দেবতাই একমাত্র ঈশ্বর ইত্যাদি কুসংস্কার ছিল ।

প্রকৃতি পূজা বিশেষ করে গাছ, কুয়া, পাহাড়-পর্বত, নদী-ঝরনা ইত্যাদি পূজার প্রচলন ছিল।

বিভিন্ন জীবজন্তু বলি দেওয়া তাদের ধর্মীয় অনুষঙ্গে পরিণত হয়।

আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত নবিগণ তাদের সকল পূজা ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত থেকে একেশ্বরের প্রতি আহ্বান জানান ।