১.৪ সুমেরীয় সভ্যতা কি বা কাকে বলে?

১.৪ সুমেরীয় সভ্যতা |

The Sumerian Civilization

আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সমকালীন টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন সভ্যতা গড়ে ওঠে, যার সম্মিলিত নাম মেসোপটেমীয় সভ্যতা।

গ্রিক ঐতিহাসিকেরা সর্বপ্রথম এ অঞ্চলের নাম দেন মেসোপটেমিয়া। এর অর্থ দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূমি।

(Mesos > between Potamos > river)। আর মেসোপটেমীয় সভ্যতার অগ্রদূত ছিল সুমেরীয় সভ্যতা।

টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস (দজলা ও ফোরাত) নদীর মধ্যবর্তী ভূখণ্ড আরব মরুভূমির উত্তরাঞ্চলকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে, এর আকৃতি দেখতে অনেকটা অর্ধচন্দ্রের মতো।

এ কারণে ভূগোলবিদ ব্রেসটেড (Breasted) এ অঞ্চলের নাম দিয়েছেন উর্বর অর্ধচন্দ্রিকা (Fertilecresent)।

পশ্চিমে মিশর থেকে শুরু করে পূর্ব পারস্য উপসাগরের তীর পর্যন্ত এ উর্বর এলাকা বিস্তৃত।

এলাকাটি কৃষি উপযোগী হওয়ায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতি যেমন— সুমেরীয়, আক্কাদীয়, ব্যাবিলনীয়, ক্যালডীয় সভ্যতা গড়ে তোলে।

১।সুমেরীয়দের পরিচয় : সুমেরীয়দের আদি নিবাস মেসোপটেমীয় অঞ্চলে ছিল না।

তারা খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের দিকের উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত এলেমের পার্বত্য অঞ্চল হতে উন্নত জীবনযাপন ও কৃষি ব্যবস্থার সুবিধার জন্য মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণের নিম্নাঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে।

সুমেরীয়দের নামানুসারে অঞ্চলটি পরিচিতি লাভ করে সুমের নামে। তাদের গড়ে তোলা সভ্যতা সুমেরীয় সভ্যতা নামে পরিচিত।

একদল ঐতিহাসিক মনে করেন, সুমেরীয়রা মধ্য এশিয়ার মালভূমি থেকে সমুদ্রপথে আগমন করেছে।

কেউ কেউ বলেন, পারস্যের সুসা অঞ্চল থেকে তারা আগমন করেছে। ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মতে, তারা যাযাবর।

বিভিন্ন পশুর জীবাশ্ম দেখে তারা বলেন, তাদের পশুপ্রীতি ছিল। একদল নৃবিজ্ঞানী মনে করেন, সুমেরীয়দের চুল ছিল কালো।

আর এ থেকে ধারণা করা হয়, কালো মাথা থেকে সুমের নামের উৎপত্তি ।

২।ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি : প্রথম পর সুমেরীয়দের রাজনৈতিক কাঠামো।

সুমেরীয়দের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কাঠামো ছিল না। উর, ত্রিপুর, লাগাস, এরিদু কি, নিপ্পর ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য নগররাষ্ট্র।

প্রত্যেকটি নগরের আলাদা প্রশাসন, দেবতা ছিল।

শুধু সামরিক প্রয়োজনে সুমেরীয়রা কেন্দ্রীয় সংগঠন বা কনফেডারেশন গড়ে তুলত।

নগররাষ্ট্রের প্রধানকে বলা হতো পাতেসি (Patesi)। fee ছিলেন একাধারে নগরপতি, সেনাপ্রধান এবং সেচ ব্যবস্থার প্রধান নিয়ন্ত্রক।
বিশেষ সময়ে তার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত।

৩।সুমেরীয়দের অর্থনৈতিক কাঠামো : সুমেরীয়দের অর্থব্যবস্থা জটিল ছিল না। তাদের প্রধান পেশা ছিল কৃষি।

জমাজমিতে সাধারণ কৃষকদের স্বত্ব বলবৎ ছিল।

তাদের সেচ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার কারণে প্রচুর পরিমাণে ফসল উৎপাদিত হতো।

তারা কাঠের লাঙল ব্যবহার, ধাতু নির্মিত কাস্তে, নিড়ানি ইত্যাদির দ্বারা উন্নত কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

শাসক, যাজক, ভূস্বামী, সামরিক কর্মকর্তা, স্বাধীন কৃষক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভূমিদাসের নিয়ন্ত্রণে কৃষি জমি ছিল।

বছরে তিনটি ফসল উৎপাদিত হতো। উৎপাদিত ফসলের মধ্যে ছিল— গম, যব, বার্লি, খেজুর ও শাকসবজি।

চাকাওয়ালা গাড়ি ও ঘোড়া গাড়ির মাধ্যমে ফসলাদি এক স্থান হতে অন্য স্থানে আনা-নেওয়া করা হতো।

তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক উৎস ছিল বাণিজ্য।

ধাতু, কাঠ, কৃষিজাত ও শিল্পজাত দ্রব্যসমূহ পার্শ্ববর্তী উত্তর ও পশ্চিমের নিচু উপত্যকার অঞ্চলসমূহের সাথে আমদানি-রপ্তানি চলত ।

প্যালেস্টাইন, ফিনিশিয়া, ক্রিট, ইজিয়ান দ্বীপসমূহ, এশিয়া মাইনর ইত্যাদি অঞ্চলের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।

উত্তর ভারতে প্রাপ্ত ‘সিল’ দেখে মনে করা হয়, সম্ভবত ভারতের সাথে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।

বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে তারা সোনা, রুপা ইত্যাদি ব্যবহার করত। তখন সুদের ব্যবসায় চালু ছিল। সুমেরীয়রা তামা ও টিন আমদানি করত ।

৪।সুমেরীয়দের সমাজ কাঠামো :
সুমেরীয় সমাজে সাধারণত তিন শ্রেণির লোক পরিলক্ষিত হয়।

যেমন- ১. অভিজাত সম্প্রদায়— রাজা, রাজপরিবার, পুরোহিত, সামন্তপ্রভু, রাজকীয় উপদেষ্টা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

২. চিকিৎসক, শিক্ষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, স্বাধীন কৃষক, কারিগর ও শ্রমিক ছিল দ্বিতীয় পর্যায়ের নাগরিক।

৩. সর্বনিম্ন স্তরে ছিল ভূমিদাস ও ক্রীতদাসরা । দাসরা যুদ্ধে স্বাধীন নারীকে বিয়ে করতে পারত না।

রাজা ছিল একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী । তবে নগরে অবস্থিত মন্দিরগুলোর কর্তৃত্ব ছিল পুরোহিতদের।

উচ্চশ্রেণি কর্তৃক নিম্নশ্রেণি শোষিত হতো। যুদ্ধে পরাজিত যোদ্ধা এবং নিঃস্ব ব্যক্তিরা দাস শ্রেণিতে পরিণত হতো।

এছাড়া হাটে দাস কেনাবেচা হতো ৷
সুমেরীয়দের সমাজ ছিল বৈষম্যমূলক এবং শ্রেণিবিভাগে বিভক্ত।

তাদের পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক। তবে নারীরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখতে পারত।

বর তার সম্ভাব্য স্ত্রীকে যৌতুক দিত। সুমেরীয়দের সমাজে প্রথমে নারীদের মর্যাদা অনেক উঁচুতে থাকলেও পরবর্তীতে নারীদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে থাকে ।

৫। সুমেরীয়দের ধর্ম : সুমেরীয়রা বহু দেবদেবীতে বিশ্বাসী ছিল।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন দেবদেবীকে পূজা করত।

সূর্য দেবতা শামাস; বন্যা, বৃষ্টি ও বাতাসের দেবতা এনলিল; পানির দেবতা এনকি; প্রেম ও উর্বরতার দেবী ইশতার; প্লেগ রোগের দেবতা নারগল ইত্যাদি দেবতা ছিল প্রধান। এছাড়া প্রত্যেকটি নগরের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দেবতা ছিল।

যেমন— উরুক নগরীর দেবী ছিলেন ইনিনি। কারের নগরের রক্ষাকারী দেবতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হতো এনলিল দেবতাকে।

এনকি দেবতাকে কৃষককুল অত্যন্ত মর্যাদাদান করত। প্রত্যেক নগরে একটি কেন্দ্রীয় মন্দির ছিল।

উর নগরীতে নির্মিত ‘জিগুরাত’ (Ziggurat) মন্দির ৭টি স্থাপত্য দিক থেকে উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

এটি উপাসনালয় ছাড়াও একাধারে শস্যগোলা, সেনাছাউনি, কোষাগার, সচিবালয় ইত্যাদি মর্যাদা ভোগ করত।

দেবদেবীর সন্তুষ্টির জন্য তারা গৃহপালিত পশু যেমন— গরু, ছাগল, ভেড়া, কবুতর, ফলমূল, মাখন, ঘি ইত্যাদি উৎসর্গ করত। তবে পরকালে তারা বিশ্বাসী ছিল না।

অনেকে ধর্মীয় প্রধান রাজার সঙ্গে কবরস্থ হওয়ার জন্য চেতনানাশক মদপান করে একই কবরে কবরস্থ হতো