৬.১২। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর ।অথবা, আগরতলা মামলার কারণ ও ফলাফল বর্ণনা কর ।

উত্তর :
ভূমিকা : আগরতলা মামলা ছিল আইয়ুব খানে শাসনামলের সবচেয়ে ঘৃণ্য প্রহসনমূলক ঘটনা। ১৯৬৬ সালে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে গণআন্দোলন জোরদার হতে থাকলে আইয়ুব খান আন্দোলনকে স্থিমিত করতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উৎখাত করার জন্য এ প্রহসনমূলহ নীতি গ্রহণে তৎপর হন।

পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্বশূন্য করে আইয়ুব খানের ক্ষমতা ও প্রভাব সুদৃঢ় করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফলই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ : নিম্নে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ আলোচনা করা হলো :

১. জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নস্যাৎ করা : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী যে চেতনাবোধের জন্ম হয়েছিল তা আরো দৃঢ় হচ্ছিল ছয় দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। আইয়ুব খান এটা উপলব্ধি করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছে তা রোধ করতে না পারলে পাকিস্তানের ভাঙন অনিবার্য হয়ে পড়বে। তাই তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিলেন ।

২. ছয় দফা আন্দোলন দমন করা : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছয় দফার আন্দোলন যখন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনমনে অভূতপূর্ব সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিল ঠিক তখন ক্ষমতাসীন আইয়ুব সরকার এ আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে নস্যাৎ করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ১৯৬৮ সালের ০১ জানুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামক একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে।

৩. শেখ মুজিবকে রাজনীতি থেকে নির্মূল করা : শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধিকার আন্দোলনের প্রাণপুরুষ এবং পূর্ববাংলার জনগণের অবিসংবাদিত নেতা। মূলত তার সুচিন্তিত নেতৃত্বের মাধ্যমেই সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন চলছিল। আর সে জন্যই আইয়ুব খান ভীতসন্ত্রস্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে নির্মূল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন।

৪. শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তায় আঘাত হানা : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও তাদের নেতাকে বিশ্বাসঘাতক প্রমাণ করে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা শূন্যে নামিয়ে আনাই ছিল এ মামলার উদ্দেশ্য।

৫. শোষণ অব্যাহত রাখা : এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এমন একটি ধারণা তৈরি হয় যে, শেখ মুজিবকে দমন করতে না পারলে তাদের অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সবই বন্ধ হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে শেখ মুজিবুর রহমানকে দমন করে তারা শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখতে চায় ।

৬. সেনাবাহিনীর সমর্থন দৃঢ় করা : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন ৩৫ জন। এর মধ্যে ৩৪ জনই ছিলেন পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কর্মরত। সেনাবাহিনরি সমর্থন দৃঢ় করা ও বাঙালি সৈন্যদের পাকিস্তানি সেনাদের নিকট বিশ্বাসঘাতক প্রমাণ করা এ মামলার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিক্রিয়া/পরিণতি/ফলাফল : নিম্নে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিক্রিয়া/পরিণতি বা ফলাফল আলোচনা করা হলো :

১. জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। কোনা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করার সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বুঝতে পারে এ মামলা তাদের কন্ঠস্বর রোধ করার উদ্দেশ্যে দায়ের করা হয়েছে। তাই জনগণ এ মামলার বিরুদ্ধে মিছিল, মিটিং, সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত প্রভৃতির মাধ্যমে শাসকবর্গের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ।

২. জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি হতে জনগণ উপলব্ধি করতে পারে যে, এ মামলা ছিল আসলে ছয় দফা আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক ঘৃণ্য চক্রান্ত । জনগণ এ মামলাকে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবির পরিপন্থী বলে মনে করে। এ ধারণাবোধ থেকে পূর্ব বাংলার জন মনে দারুন এক জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়।

৩. শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : শেখ মুজিবের জবানবন্দি দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা সমগ্র দেশে এক বিরাট রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে যে ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দণ্ডিত করা হয়েছিল সে ব্যক্তি নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং দেশের সর্বাপেক্ষ। সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হন।

৪. বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচি ঘোষণা : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিক্রিয়ার বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১৭ জানুয়ারি থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ হরতাল, মিছিল, সভা-সমাবেশ আয়োজন করে। ঐদিনই গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটিও অনুরূপ কর্মসূচি ঘোষণা করে।

৫. সরকারি দমন-পীড়ন : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলন নস্যাৎ করতে সরকার দমন-পীড়ন চালায়। এ ছাড়া স্বাধীন মতামত প্রকাশেও নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। এ পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে সেনাবাহিনীও তলব করা হয়। বস্তুত গণবিক্ষোভ দমনে আইয়ুব সরকার কোনো পন্থাই বাকি রাখে নি ।

৬. গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিক্রিয়াস্বরুপ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনের সূচনা হয়। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় এগারো দফার ভিত্তিতে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। এ সময় বিভিন্ন কর্মসূচি পালনকালে পুলিশি দমন-পীড়ন ও নির্যাতনে বহু ছাত্র-জনতা গ্রেফতার, আহত ও নিহত হয় । ফলে এ আন্দোলন ক্রমান্বায়ে গণঅভ্যুত্থানের রূপ পরিগ্রহ করে।

৭. মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবকে মুক্তিদান : প্রবল গণঅভ্যুত্থানের কারণে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফ্রেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। ঐদিনই জনতার চাপে শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ।

৮. আইয়ুব খানের পতন : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে প্রচণ্ড আনেন সংগ্রাম শুরু হয়। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান শহীদ হন।

২৪ জানুয়ারি প্রতিবাদ সমাবেশে নবকুমার স্কুলের ছাত্র মতিউর রহমান শহীদ হন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিহিংসাবশত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করে।

১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হত্যা করা হয় ড. শামসুজ্জোহাকে। ফলে প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৬৯ সালের ২১ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি ঘৃণ্য প্রতিহিংসা ও দমন-পীড়নমূলক মামলা। নির্দোষ ব্যক্তিদেরকে কাল্পনিক মামলায় জড়িয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলার স্বাধিকার আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রবল দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী মনোভাবের কারণে চক্রান্তকারীরা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।