গণঅভ্যূত্থানের কারণ কি
ভূমিকা : ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ছাত্রসমাজের ১১ দফা এবং আওয়ামী লীগের ৬ দফার ভিত্তিতে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন, জরুরি আইন প্রত্যাহার প্রভৃতি দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হয়।
কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ছাত্রসমাজের ১১ দফা এবং জনতার ৬ দফা দাবিকে রাষ্ট্রবিরোধী দাবি বলে ঘোষণা করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা সাজিয়ে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে।
এর ফলশ্রুতিতে সমগ্র বাংলাদেশে ছাত্র-জনতা আন্দোলনের রুদ্ররোষে ফেটে পড়ে এবং ধীরে ধীরে এ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয় ।
১. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা :
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ : ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো : বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি ৬ দফাকে চিরতরে নস্যাৎ করার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে চক্রান্ত করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল তারই ফলশ্রুতি। এ মামলার প্রধান আসামি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
এ মামলার লক্ষ্য ছিল বাঙালি স্বায়ত্তশাসনবাদীদের ভীতি প্রদর্শন করা এবং তাদের নেতা শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করা । কিন্তু বাস্তবে এর ফল হয় বিপরীত।
২. পাক শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্ত ও দমন নীতি : পাক শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি চক্রান্ত ও দমননীতির ফলে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বিরাজমান বিভেদ, অবিশ্বাস ও ঘৃণার মনোভাব আরো তীব্রতর হয় । শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বাংলার মানুষের সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি বাঙালিদের জাতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ফলে তার আহ্বানে পাক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত বাঙালি জনতা গণঅভ্যুত্থানে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৩. আইয়ুববিরোধী বিক্ষোভ : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলে পূর্ববাংলার জনগণ যখন চরম বিক্ষুব্ধ ঠিক সে সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুববিরোধী বিক্ষোভ তীব্র হয়ে উঠে। ১৯৬৬ সালে মন্ত্রিসভা হতে পদত্যাগের পরেই জুলফিকার আলী ভুট্টো আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী অভ্যুত্থান
নতুন মাত্রা পায় ।
৪. ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন : পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকে স্বাগত জানায় এবং ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ধর্মঘট পালন করে। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন অতি দ্রুতগতিতে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করে। আন্দোলন পরিচালনার জন্য তৎকালীন ‘ডাকসু’ সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে এক ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি এ সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবি সংবলিত একটি কর্মসূচি ঘোষণা করে । ফলে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়।
৫. ১১ দফার প্রতিক্রিয়া : ১১ দফা দাবির মধ্যে শুধু ৬ দফাভিত্তিক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথাই ছিল না, এতে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক সকল শ্রেণীর মানুষের শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার দাবিও অন্তর্ভুক্ত হয়। সেজন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে বাংলার আপামর জনতা আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে সাড়া দেয় ৷
৬. দমননীতি ও পরিণতি : আইয়ুব সরকার গণবিপ্লবকে দমন করার জন্য কোনো পন্থাই বাদ রাখেন নি কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা যতই বাড়তে তাকে ছাত্র-জনতার জঙ্গি মনোভাব ততই দৃঢ়তর হয়। পল্টনের এক জনসভায় মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান। তিনি বলেন,
“এ দাবির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করতে থাকলে পূর্ব পাকিস্তানবাসী বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন পূর্ববাংলা গঠন করবে।” এরপর থেকে সমগ্র পূর্ববাংলা হয়ে উঠল হরতাল, মিছিল আর বিক্ষোভের দেশ।
পুলিশ ও সেনাবাহিনীর জুলুম, নির্যাতন ও গুলি চলল সমানভাবে। আসাদ, মতিউর, ড. জোহা, সার্জেন্ট জহুরুল একে একে প্রাণ দিলেন গণঅভ্যুত্থানের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ১৯৬৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সমগ্র পাকিস্তানে জেনারেল আইয়ুব এর একনায়কতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।