সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সমস্যা ৷ ( Problems of Good Governance):

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সমস্যা :
Problems of Good Governance

সুশাসন প্রতিষ্ঠা যেকোনো জাতির জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জস্বরূপ

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জাতিকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়।

১। দুর্নীতি : সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম বাধা হলো দুর্নীতি। মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বস্তরে সীমাহীন দুর্নীতি পরিলক্ষিত হলে সুশাসন অনিশ্চিত হয়ে যায়।

রাষ্ট্রের দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্য অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নিরোধ ব্যবস্থাগুলোর গতিশীলতার অভাবে দুর্নীতি স্থায়ী ব্যাধির রূপ নেয়।

অনিয়ম ও দুর্নীতি সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলে। এভাবে দুর্নীতি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ।

২। স্বজনপ্রীতি : সরকারি-বেসরকারি চাকরির নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারের উচ্চ মহলের পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বজনপ্রীতি সুশাসনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অদক্ষ ও অযোগ্য লোকের কর্মসংস্থান হয়, অন্যদিকে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির অধিকার খর্ব হয়।

৩। আইনের শাসনের অভাব : আইনের শাসনের অভাবে জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে।

আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবহেলা বা বিলম্ব হলে রাষ্ট্রে অপরাধপ্রবণতা ও দুর্নীতি বেড়ে যায়।

নাগরিকের দুর্ভোগ বৃদ্ধির সাথে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সুশাসন বাধাগ্রস্ত
হয়।

৪। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অনুপস্থিতি : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্রের জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।

অনেক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের উপর শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বিস্তারের ফলে বিচার ‘বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়।

বিচারকদের নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দলীয়করণের ফলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়; যা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তরায়।

৫। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল :
উন্নয়নশীল দেশে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ,

সহিংসতা ইত্যাদি কারণে সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও ক্ষমতা দখল গণতান্ত্রিক শাসনপ্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

সামগ্রিকভাবে সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অংশগ্রহণ সুশাসনের পথে অন্তরায়।

৬। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা : উন্নয়নশীল দেশে আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে সুশাসন বাস্তবায়ন হয় না।

আমলারা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কর্মসূচি গ্রহণ, নীতিনির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও এর যথাযথ বাস্তবায়নে মন্ত্রীদের পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে থাকেন।

এক্ষেত্রে আমলাদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার অভাব হলে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে জটিলতা বৃদ্ধি পায় এবং সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা আসে ।

৭। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব : গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সুশাসনের অন্যতম পূর্বশর্ত।
আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেমন—
অন্যের মতের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা, সহিষ্ণু মনোভাব, নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া ইত্যাদি গুণের বিকাশ ঘটতে দেখা যায় না।

ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং সুশাসন অসম্ভব হয়ে পড়ে।

৮। দুর্বল স্থানীয় সরকারব্যবস্থা : শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় জন-অংশগ্রহণ তথা জনকল্যাণ সুনিশ্চিত হয়।

স্থানীয় সরকার কাঠামোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সমন্বয়হীনতা উন্নয়ন কার্যক্রমকে ব্যাহত করে।

৯। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব : সুশাসনের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতার অভাব।

জবাবদিহিতা না থাকলে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করে। সরকারি কর্মকাণ্ড জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হয় না।

জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে জনগণ সরকারের কাজে আস্থা রাখতে পারে না। সরকার ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।

১০। অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের অভাব : অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করে।

নির্বাচনব্যবস্থায় পক্ষপাতিত্ব ও কারচুপি দুর্নীতিকে প্রশ্রয়দান ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রা বৃদ্ধি করে। অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, জন-অংশগ্রহণমূলক ও দায়িত্বশীল নির্বাচনব্যবস্থার সংকট সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে ।

১১। যোগ্য নেতৃত্বের অভাব : উন্নয়নশীল দেশে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অধিক।

সুদৃঢ় নেতৃত্ব রাষ্ট্রকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে, সংকটকালে হাল ধরার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং সর্বোপরি উন্নয়নের লক্ষ্যে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করো যায়।

১২। সহিংস রাজনীতি : সহিংস রাজনীতি জননিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য হুমকিস্বরূপ।

এতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়, অবকাঠামোগত উন্নয়নে স্থবিরতা আসে।

উন্নয়নশীল দেশে রাজনীতিতে ক্ষমতার লড়াই, আন্দোলন কর্মসূচির নামে রাজনৈতিক সহিংসতা, সংঘাত, নৈরাজ্য ইত্যাদি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে কলুষিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও সুশাসনের পথ রুদ্ধ করে।

১৩। সামাজিক অসমতা : বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় সামাজিক সাম্য ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়।

ধনী-গরিবের বৈষম্য ও আয়ের অসমতা সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পেলে জন-অসন্তোষ দানা বাঁধে, সামাজিক অস্থিতিশীলতা বাড়ে ।

১৪। নারীশিক্ষার অভাব : নারীশিক্ষা বিস্তার লাভ করলে নারীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি নারীর আত্মমর্যাদা ও ক্ষমতায়ন সম্ভব হবে।

কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে নারীশিক্ষার প্রতি নানাবিধ সামাজিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টি পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী হিসেবে তাদের পরিগণিত করায় নারীর শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয় না।

পশ্চাৎপদ নারীগোষ্ঠী যথাযথ শিক্ষার অভাবে পরিবার ও সামাজি উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হয় না।

১৫। দারিদ্র্য্য উন্নয়নশীল দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে দারিদ্র্য। দরিদ্রতার কারণে মানুষ অশিক্ষা
অপুষ্টি ইত্যাদির শিকার হয়।

অশিক্ষার কারণে জনগণ অনেক সময় সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয় না এবং সুশাসনে কোনো ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় না।

১৬। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অভাব : সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন ও শক্তিশালী গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা করে।

পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন প্রভৃতি গণমাধ্যমের দ্বারা জনগণ রাজনৈতিক ও আমলাদের কর্মকারে ভালোমন্দ দিক অনুধাবন করতে পারে।

এতে প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। অনেক দেশে পত্র-পত্রিকাগুলোতে সরকারি কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির খবর প্রচারিত হলে সরকার এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় যা সুশাসনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

তাছাড়া অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার গণমাধ্যমের উপর অযথা হস্তক্ষেপ করার কারণে গণমাধ্যমগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তথ্য প্রচার করতে পারে না। ফলে সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়।

১৭। ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব : সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা আবশ্যক।

কেননা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার বণ্টন প্রয়োজন।

এ ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকতে হবে এবং জনপ্রতিনিধিদের কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে যথাযথ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি আইনসভা থাকতে হবে।

এর বাইরে রয়েছে নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ ভূমিকা।

এসব প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ব্যতীত সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে কল্পনামাত্র।

কারণ এ প্রতিষ্ঠানগুলোই সরকারের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।

১৮। কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামো : রাষ্ট্রের শাসন কাঠামোর মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এ শাসন কাঠামো যদি কর্তৃত্ববাদী হয় তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

একটি দেশের শাসন কাঠামো দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে নামসর্বস্ব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিকব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে।

এসব দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক রীতিনীতিগুলো যেমন-সার্বজনীন ভোটাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সভা-সমিতির অধিকার প্রভৃতি বহাল থাকে ঠিকই কিন্তু কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামোর জন্য তা কার্যকর হয় না।

শাসকগোষ্ঠী গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেও ক্ষমতা চর্চা করার ক্ষেত্রে নিজেদের ইচ্ছামূলক কার্যপরিচালনা করে।

তারা যেকোনো মূল্যে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। এছাড়া এসব দেশে সনাতনী উত্তরাধিকার ভিত্তিক ক্ষমতা কাঠামোও বিদ্যমান থাকে।

ফলে কোনো ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণিতে জন্মগ্রহণ করার কারণে নাগরিকগণ তাকে ভবিষ্যৎ শাসন ক্ষমতার অধিকারী মনে করে।

কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামোতে নাগরিকগণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলেও তারা মনে করে যে, তারা কখনও নেতা হতে পারবে না।

নেতা হবেন যারা বংশ পরম্পরায় নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন তাদের উত্তরসূরীরাই। কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামোতে স্বাধীনভাবে গণতন্ত্রের চর্চা না হয়ে পরিবারতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর চর্চা করা
হয়।

১৯। তথ্য অধিকার আইনের দুর্বল বাস্তবায়ন : জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন একটি যুগান্তকারী আইন।

তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করে। দুর্নীতি নির্মূল করতে এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে।

তথ্যের অবাধ প্রবাহের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র আছে যেখানে তথ্য অধিকার আইন এখনও প্রণয়ন করা হয়নি।

আবার অনেক রাষ্ট্রের তথ্য অধিকার আইন থাকলেও এর কার্যকারিতা খুবই দুর্বল।
এর ফলে ঐ রাষ্ট্রের জনগণ বিভিন্ন তথ্য বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছুই জানতে পারে না।

এতে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব দেখা দেয়। যা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাধা।
হিসেবে কাজ করে ।