১১ প্রশ্ন: ৫.২। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পটভূমি আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির প্রধান কারণগুলো উল্লেখ কর।

সামরিক শাসন জারি:

ভূমিকা : ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির দীর্ঘদিন পর পাকিস্তানের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রবর্তিত হলেও এক অন্তর্নিহিত ত্রুটি সংসদীয় ব্যবস্থাকে প্রায় অকার্যকর করে দেয়। উপরন্তু ১৯৫৪-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতিতে চরম অস্থিতিশীলতা বিরাজ করতে থাকে। প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ঘন ঘন পরিবর্তনের ফলে সাংবিধানিক কার্যক্রমে চরম জটিলতা দেখা দেয়। এহেন অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে সুচতুর ও ক্ষমতালোভী প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর এক বিশেষ ঘোষণার মাধ্যমে সমগ্র দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারি করেন।

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পটভূমি বা কারণ : নিম্নে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পটভূমি বা কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে শূন্যতা : পাকিস্তানের জনক ও প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও তার প্রধান সহযোগী লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর থেকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মান স্থায়ীভাবে নেমে যায় এবং সৃষ্ট শূন্যতায় সামরিক বাহিনীর প্রবেশের সম্ভাবনা বাড়ে। অচিরেই দুর্বল নেতৃত্বচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের উপর সশস্ত্র বাহিনীর আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিরক্ষা বাজেট স্ফীত হতে থাকে এবং তদনুসারে সশস্ত্র বাহিনী অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে। ঘন ঘন পদোন্নতি ও অঢেল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা
সত্ত্বেও সামরিক অফিসারদের লোভ-লালসা বেড়েই চলে।

ক্রমে তারা অসামরিক কর্তৃপক্ষকে অযোগ্য বলে অবজ্ঞা করতে থাকে। এভাবে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা ও অনেকাংশে শূন্যতার কারণে সামরিক বাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়, যা ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পথকে প্রশস্ত করেছিল।

২. সামরিক বাহিনীর মধ্যে সরকার উৎখাতের চক্রান্ত : ১৯৪৮ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর থেকে পাকিস্তানের সমাজে ও রাষ্ট্রে সশস্ত্র বাহিনী একটা পরাক্রান্ত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ সময় কোনো কোনো সামরিক অফিসারের মনে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়।

এ পরিস্থিতিতে ১৯৫১ সালের ১৭ জানুয়ারি জেনারেল গ্রেসির নিকট থেকে পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন জেনারেল আইয়ুব খান। এর অল্প পরেই সেনাবাহিনীতে সরকার উৎখাতের এক ষড়যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। ‘রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত এ চক্রান্তের হোতা
ছিলেন স্থলবাহিনী প্রধান জেনারেল আকবর খান। শেষ মুহূর্তে অসামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রচেষ্টায় এই চক্রান্ত ব্যর্থ
হলেও তা পরবর্তীকালে সামরিক শাসকদের ক্ষমতা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।

৩. ইস্কান্দার মির্জার গভর্নর জেনারেল পদ গ্রহণ : ১৯৫৪ সালের ৩০ মে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার পতনের পর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সচিব ইস্কান্দার মির্জা পূর্ব বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন। এ সময় থেকে ইস্কান্দার মির্জা সামরিক বাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠ আঁতাত গড়ে তোলেন। ১৯৫৫ সালের ৭ আগস্ট তিনি সামরিক বাহিনীর মদদে গভর্নর জেনারেল) গোলাম মোহাম্মদকে ক্ষমতাচ্যুত করে পাকিস্তানের অস্থায়ী গভর্নর জেনারেলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের
গভর্নর জেনারেলের পদে ইস্কান্দার মির্জার আবির্ভাব ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির পথকে ত্বরান্বিত করে।

৪. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পর থেকে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করতে থাকে। এর মধ্য দিয়ে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণীত হলেও তাতে পূর্ব পাকিস্তানিদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে নি। প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা না থাকায় প্রথম থেকেই এর প্রতি বাংলার রাজনৈতিক মহল প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। শুধু তাই নয়, ১৯৫৪-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে মন্ত্রিসভায় ঘন ঘন পরিবর্তন সূচিত হয়। এ পরিবর্তন পাকিস্তানের সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থাকে আরো অস্থিতিশীল করে তোলে, যা সামরিক শাসনের পথকে ত্বরান্বিত করে।

৫. সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অভাব : ১৯৫৬ সালে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও তার কার্যকরী করার জন্য সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল তীব্র মাত্রায়। প্রত্যেক রাজনৈতিক সংগঠন অন্তর্কলহে নিমগ্ন থেকে জনপ্রিয়তা ও পার্লামেন্টে নিজেদের অবস্থান হারিয়ে ফেলেছিল।

৬. রাষ্ট্রপডির অসীম ক্ষমতা : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে সীমাহীন ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ইস্কান্দার মির্জা প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করে সরকার পরিচালনায় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা প্রয়োগ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করতে থাকেন। রাষ্ট্রপতির এ সীমাহীন ক্ষমতার ফলেই সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়ে এবং সামরিক শাসনের পথ উন্মুক্ত হয়।

৭. আমলাদের ষড়যন্ত্র : ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পশ্চাতে আমলাদের ষড়যন্ত্র ব্যাপকভাবে কাজ ক
করেছে। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ লাভ করলে নতুন মন্ত্রিসভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান। বস্তুতপক্ষে তখন থেকে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে
মুসলিম লীগের স্বার্থান্বেষী চক্রের সাথে সামরিক ও বেসারিক আমলারা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়।

৮. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতা : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির সরকার ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কার্যকরী হয় নি। এ ব্যর্থতা সামরিক শাসন জারির ক্ষেত্র তৈরি প্রবর্তনের কথা বলা হলেও তা ছিল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।

৯. ১৯৫৯ সালের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে পরাজয়ের ভয়: ১৯৫৮ সালের মধ্যভাগে পাকিস্তানের উভয় অংশে সাধারণ নির্বাচনের জোর দাবি উঠে। ব্যাপক দাবির মুখে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা প্রদান করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নির্বাচনে পরাজয়ের ভয়ে ভীত ছিল। আর এ ভীতি সামরিক শাসনকে ত্বরান্বিত করে।

১০. পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে গোলযোগ ও শাহেদ আলীর মৃত্যু: ১৯৫৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন যখন শুরু হয় তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন ছিল। ২৩ সেপ্টেম্বর পরিষদের অধিবেশন বসলে সরকারি দল ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে ভারপ্রাপ্ত স্পিকার বলে স্বীকার করে নিলেও কৃষক-শ্রমিক পার্টির সদস্যরা এর প্রতিবাদ জানায়। তবে দ্বিতীয় আলাকে ভারপ্রাপ্ত স্পিকার বলে থাকার কারনে তার ফলে দুই পক্ষের মধ্যে প্রকাশ্যে হাতা-হাতি ও প্রচণ্ড মারামারি শুরু হয়ে যায়।

এমনকি কৃষক-শ্রমিক পার্টির সদস্যবৃন্দের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে শাহেদ আলী স্পিকারের চেয়ারে বসামাত্র তার দিকে বিভিন্ন বস্তু নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। একটি ভারী কাঠের বস্তুর আঘাতে শাহেদ আলী গুরুতর আহত হন এবং ২৬ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে শাহেদ আলী মৃত্যুবরণ করে। তার মৃত্যুতে রাজনৈতিক অবস্থা গুরুতর হতে থাকলে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতাসীন ফিরোজ খান নুনের সংসদীয় সরকারকে উৎখাত করে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বিভিন্ন কারণের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর এক আদেশ বলে সামরিক শাসন জারি করেন এবং জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন। অতঃপর তিনি ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ ও সরকারসমূহ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। রাজনৈতিক দলসমূহ নিষিদ্ধ করেন এবং মৌলিক অধিকারসমূহ কেড়ে নিয়ে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু সতেরো দিনের মাথায় ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইস্কান্দার মির্জাকে অপসারিত করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করে সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

সামরিক শাসন জারি
সামরিক শাসন জারি
সামরিক শাসন জারি

১১ প্রশ্ন: ৫.২। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পটভূমি আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির প্রধান কারণগুলো উল্লেখ কর।

• January 9, 2023 • No Comments

সামরিক শাসন জারি: ভূমিকা : ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৪৭ সালে …

আইয়ুব খানের শাসন

প্রশ্ন : ৫.১। আইয়ুব খানের শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। অথবা, পাকিস্তান আমলের সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধর।

• January 9, 2023 • No Comments

আইয়ুব খানের শাসন: ভূমিকা :১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে হটিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ এবং সামরিক শাসন …

আইয়ুব খানের শাসন

১১ প্রশ্ন : ৪.৯। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রভাব আলোচনা কর। অথবা, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা কর। অথবা, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।

• January 7, 2023 • No Comments

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য: উত্তর : ভূমিকা : ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন ও এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মহাবিজয় লাভ ছিল …

আইয়ুব খানের শাসন

১১ প্রশ্ন : ৪.৮। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও মুসলীম লীগের পরাজয় এর কারণসমূহ আলোচনা কর। অথবা, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় ও যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণ লিখ।

• January 7, 2023 • No Comments

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় ও যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণ: ভূমিকা : ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন এবং এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও …

More..

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related