সমাজজীবনে বংশগতির প্রভাবসমূহ কি কি

সমাজজীবনে বংশগতির প্রভাব

Influence of Heredity in Social Life

সমাজ ও সভ্যতার ওপর বংশগতির প্রভাব অনুধাবন করতে হলে জৈবিক নিয়ন্ত্রণবাদ সম্পর্কে বিশেষ ধারণা ধর আবশ্যক।

জৈবিক নিয়ন্ত্রণবাদ বর্ণবাদের সাথে যুক্ত হওয়ার কারণে একে আজকাল আর বিজ্ঞানসম্মত ধারণা হিসেবে স্বীকার করা হয় না।

তবু একথা সত্য যে, সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের পিছনে মানুষের বংশগতির প্রভাব সামান্য হলেও বিদ্যমান। জৈবিক নিয়ন্ত্রণবাদে যারা বিশ্বাসী তাদের মতে উৎকৃষ্ট জৈবিক বৈশিষ্ট্যাবলি মানবসভ্যতার বিকাশ ও অগ্রগতি ক্ষেত্রে অনুকূল ভূমিকা পালন করে।

জৈবিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উৎকৃষ্ট গুণাবলির অভাব ঘটলে সভ্যতার পতন অবশ্যম্ভাবী। বংশগতি একটি জৈবিক প্রক্রিয়া।

মানুষের দেহের গঠন, প্রকৃতি ও তার স্বভাব চরিত্র এক জৈব প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই সৃষ্ট হয়। যে জৈবিক প্রক্রিয়ায় পূর্বপুরুষের কিছু দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকার সূত্রে পরবর্তী বংশে সন্তান-সন্ততির মধ্যে সঞ্চালিত হয় তাকে বংশগতি বলে।

অধ্যাপক বিদ্যাভূষণ ও সচদেব বলেন, “The biological or psychological characteristics which are trammitted by the percents to their offspring’s are known by the name of heredity.

Heredity is, in other words, a biologial process of transmission of certain traits of behaviour of parents to their children, by means of fertilized egg.”

অর্থাৎ বংশগতি হচ্ছে মানুষের দৈহিক বা মানসিক বৈশিষ্ট্যসমূহ যা বাবা-মায়ের মাধ্যমে তাদের সন্তান-সন্ততির মাঝে সঞ্চালিত হয়।

এক কথায় বংশগতি হচ্ছে বাবা-মায়ের কিছু আচরণগত বৈশিষ্ট্য তাদের সন্তান-সন্ততির মাঝে সঞ্চালনে একটি জৈবিক প্রক্রিয়া, যা সম্পন্ন হয়ে থাকে উর্বর ডিম্বাশয়ের মাধ্যমে।

অন্যভাবে ‘বংশগতি’ বলতে মানুষের দৈহিক ব মানসিক গুণাবলির সমন্বিত ক্ষমতাকে বোঝায়। যে ক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব বিস্তর করছে।

মানুষের বংশগত বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বিস্তার লাভ করে । সাধারণত বংশগত সূত্রে যেসব বৈশিষ্ট সন্তানদের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তায় তা হলো লিঙ্গ (স্ত্রী-পুরুষ), চোখ, চুল,

গায়ের রং, চুলের ধরন এবং শরীরে বিভিন্ন স্থানে তার বণ্টন, আঙুলের ছাপ, হাত-পায়ের ধরন ও গঠন, দেহের গড়ন, রক্তের রাসায়নিক গঠনপ্রকৃতি, রক্তে গ্রুপ, জ্ঞান ও দক্ষতা, মস্তিষ্কের পারদর্শিতা, রোগব্যাধি, রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা ইত্যাদি।

অ্যারিস্টটলের মতে, “জন্মগতভাবেই কেউবা দাস এবং কেউবা মনিব। দাস ছাড়া মনিব এবং মনিব ছাড়া দাস কল্পনাই
করা যায় না।”

সমাজবিজ্ঞানী আর. এম. ম্যাকাইভার এবং পেজ-এর মতে, ‘Heredity the germ cellscontains all the potentialities of life, but all its actualities are evoked within and under the conditions of environment’

অর্থাৎ বংশগতির মধ্যেই জীবনের সকল সুপ্ত শক্তি নিহিত থাকে। কিন্তু এ সুপ্ত শক্তির বিকাশ সম্ভব হয় পরিবেশের মাঝে এবং পরিবেশের সহায়তায় ।

আবার অনেকের মতে, দৈহিক স্বাস্থ্য ও শক্তির প্রতিভা প্রত্যক্ষভাবে বংশগতির ওপর নির্ভরশীল।

অপরদিকে, মানুষের চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণা সামাজিক গুণাবলির আচার-বিশ্বাস ইত্যাদি পরিবেশের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়। গ্যালটন, পিয়ারসন, ম্যাকডুগাল প্রমুখ চিন্তাবিদরা বংশগতির ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

পক্ষান্তরে, বাল, মন্টেস্কু, হান্টিংটন, ওয়াটসন প্রমুখ সমাজচিন্তাবিদ ভৌগোলিক পরিবেশের প্রভাবকে অধিকতর মূল্য দিয়েছেন।

এদের ভেতর কেউ কেউ বলেন, দৈহিক স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিবিশেষের প্রতিভা প্রত্যক্ষভাবে বংশগতির ওপর নির্ভরশীল । অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন, পরিবেশ মানুষের সামাজিক গুণাবলি, আচার, বিশ্বাস ও ধ্যানধারণার, বিকাশে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে।

ওয়াটসন-এর মতে, “দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকার সূত্রেই বর্তিয়ে থাকে।
গ্যান্টন তার ‘Heredity Gentas’ গ্রন্থে বলেন, ‘পিতা-মাতা উন্নত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হলে সে ক্ষেত্রে সন্তান-সন্ততির প্রতিভাসম্পন্ন হবার সুযোগ বেশি।’

অর্থাৎ, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, প্রতিভা এবং দক্ষতা বংশগতিসূত্রে প্রাপ্ত ।
লাপোজ (Lapouge) বলেন, নৃগোষ্ঠী যদি নিকৃষ্ট গুণের অধিকারী হয় তবে শিক্ষা বা অনুকূল পরিবেশ তার মধ্যে তেমন আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন আনতে পারে না।

জন্মগতভাবে নির্বোধ ব্যক্তিকে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, নানা কারণে উৎকৃষ্ট নৃগোষ্ঠীর লোকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

এতে রক্তের উৎকৃষ্ট জৈবিক বা রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য লোপ পাচ্ছে। এ কারণেই অনেক সভ্যতা অতীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং আধুনিক অনেক সভ্যতাই এ কারণে ধ্বংসের সম্মুখীন।

যুদ্ধ ও রাজনৈতিক কারণে অনেক উৎকৃষ্ট লোক বিচারের প্রহসনে আজীবন কারাগারে কাটায়। ক্যাথলিক ধর্মীয় যাজকেরা বিবাহ না করায় তাদের বংশবৃদ্ধি পায় না।

এভাবে উৎকৃষ্ট নৃগোষ্ঠীর লোকের সংখ্যা কমে আসছে বিধায় সভ্যতা ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে । উল্লেখ্য, বর্ণবাদীদের এসব বক্তব্য পুরাপুরি গ্রহণযোগ্য নয় ।

কার্ল পিয়ারসন (Kari Pearson) বলেন, দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকার সূত্রেই বর্তিয়ে থাকে। মূলত তিনিও গ্যান্টনের সাথে একমত।

পিয়ারসন মনে করেন, মানবজাতির বিকাশে জৈবিক উপাদানই প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে। জৈবিক উপাদানই কোনো জাতির উত্থান-পতনের জন্য দায়ী।

বর্ণবাদী নৃবিজ্ঞানী গবিনের মতে, “সমাজ ও সভ্যতার উন্নতি ও অবনতির মূলে নৃগোষ্ঠীগত উপাদানই দায়ী।’

সরোকিন বলেন, ‘একই সমাজের মানুষের মধ্যে জন্মসূত্রে দৈহিক ও মানসিক পার্থক্য বিদ্যমান। তার মতে, উচ্চ শ্রেণির লোকদের সন্তানদের বুদ্ধিমত্তা (IQ) নিম্নশ্রেণির লোকদের চেয়ে অনেক বেশি।

এ সম্পর্কে জীববিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, পরিসংখ্যানবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং আরও অনেকে গবেষণা করেছেন।

নিয়ন্ত্রণাধীন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পরিবেশ ও বংশগতির আপেক্ষিক গুরুত্ব পরিমাপের প্রচেষ্টা করা হয়েছে। সমাজ মনোবিজ্ঞানীরা ব্যক্তিত্ব গঠনের ক্ষেত্রে বংশগত উপাদানের ভূমিকাকে দায়ী করে থাকেন।

যমজ সন্তানদের বংশগত গুণের আশ্চর্য মিল দেখা যায়। বিশেষ করে যখন যমজ সন্তান মাতৃগর্ভের একই স্ত্রী-ডিম্ব থেকে উদ্ধৃত হয়।

এত মিল সহোদর সন্তানদের ভেতর দৃষ্ট হয় না। তবে যমজ সন্তানেরা একই পিতামাতার গৃহে পালিত হয় বলে অনেকটা একই ধরনের পরিবেশ পায়।

সেজন্য যমজ সন্তানদের জন্মের পর আলাদা করে বড় হওয়ার সুযোগ দিয়ে অভিবীক্ষণ কার্য চালনা দরকার।

কিছুকাল আগে আমেরিকায় এইচ, এইচ. নিউম্যান (জীববিজ্ঞানী), এফ. এন. ফ্রীম্যান (মনোবিজ্ঞানী) এবং কে. জে. হলিংগার (পরিসংখ্যানবিদ) একযোগে এ ধরনের গবেষণা চালান। তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত

হন যে, বিভিন্ন পরিবেশে বর্ধিত যমজ সন্তানদের দৈহিক প্রকৃতির (Physical trits) ওপর পরিবেশের প্রভাব বেশ কম।

অন্যদিকে, বিভিন্ন পরিবেশে লালিত যমজ সন্তানদের জীবনে সাফল্য ও দক্ষতা অর্জন বহুলাংশে তাদের পরিবেশের সুযোগ, সুবিধার ওপরই নির্ভর করে।

এছাড়া বিভিন্ন পিতামাতার সন্তান একই পরিবেশে রাখার ফলে কী হয় সে সম্পর্কেও গবেষণা হয়েছে। আমেরিকার আইওয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের গবেষণা চালানো হয়েছিল।

১৫০টি অনাথ সন্তানকে বিভিন্ন পরিবেশে অর্থাৎ বিচ্ছি আর্থিক, শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক পরিবেশে নানা পালক পিতামাতার কাছে ভরণ-পোষণের জন্য সমর্পণ করা হয়।

সন্তানহীন স্বামী-স্ত্রী অনেক সময়ই অনাথ সন্তানদেরকে নিজ সন্তানের মতো লালন-পালন করে থাকে।

তাদের সম্পর্কে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে এ সিদ্ধান্ত করা গেছে যে, বুদ্ধিমত্তাসহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল।

সোভিয়েত ইউনিয়নে লাইসেংকো বিতর্ক
পরিবেশ ও বংশগতির আপেক্ষিক গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের লাইসেংকো বিতর্কের কথা বলা যায়।

সোভিয়েত দাবি করে, বৈজ্ঞানিক প্রণালিতে উন্নত ধরনের কৃষির সাহায্যে উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো যায়।

আরও দাবি করে, পুরনো পদ্ধতিতে প্রজননবিদেরা উন্নত ধরনের শস্যবীজ উৎপাদনের জন্য যেখানে দশ-বারো বছর লাগায়, লাইসেংকো দুই-তিন বছরের ভেতর তা সমাধা করতে পারে।

লাইসেংকো এভাবে বুনিয়াদি প্রজনন বিজ্ঞানকে আমল দিতে অস্বীকার করে। মেনডেলিজম পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের সাহায্যে যেভাবে বংশগতিকে নির্ধারণ করে, লাইসেংকোইজম তা পরিত্যাগ করে (অস্বীকার করে) নতুন পথে অগ্রসর হতে থাকে ।

ক্রোমোজম, জিন, বংশপরম্পরায় যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাদি নির্ধারণ করে থাকে তাকে অস্বীকার করে লাইসেংকোইজম পরিবেশের ওপরই গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

এখানে বলা প্রয়োজন যে, মেনডেলপন্থিরা বংশগতির উত্থান-পতনের সাথে সাথে লাইসেংকোইজমের উত্থান-পতন জড়িত।

এখানে সে প্রশ্নে না গিয়েও মোটামুটিভাবে বলা যায়, পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা বংশগতির ওপর যতটুকু গুরুত্ব দেন সোভিয়ের বিজ্ঞানীরা ততটুকু দিতে রাজি নন।

তাদের মতে, সমাজ প্রধানত পরিবেশের দ্বারাই প্রভাবিত । বংশগতির প্রভাব খুবই নগণ্য। উপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সমাজজীবনের ওপর বংশগতির প্রভাব অনস্বীকার্য।

বস্তুত প্রতিট মানুষই জন্মসূত্রে কিছু জৈবিক ও মানসিক গুণাবলি অর্জন করে, যা ব্যক্তির জীবনে তথা তার সামাজিক জীবনের বিধি কর্মকাণ্ডে বিশেষ প্রভাব রাখে।