রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর পার্থক্য

রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর পার্থক্য
Differences between Political Party and Pressure Group

সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রত্যয় হলো রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী।

রাজনৈতিক দল বলতে কোনো একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত গোষ্ঠীকে বোঝায়, যাদের লক্ষ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে জনসমর্থনের সহায়তায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা এবং নিজ দলীয় মতাদর্শের বাস্তবায়ন করা।

রাজনৈতিক দল হলো একটি সংঘবদ্ধ জনসমষ্টি, যারা দেশের নানা সমস্যা চিহ্নিত করে, সমাধানের উপায় বের করে জনগণের কাছে তা প্রচার করে জনসমর্থন লাভের চেষ্টা করে এবং ক্ষমতায় গিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার গঠন করে।

যেমন : ভারতে কংগ্রেস, জনতা পার্টি, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় পার্টি ইত্যাদি।

অপরদিকে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে এমন একটি সমভাবাপন্ন গোষ্ঠীকে নির্দেশ করা হয়, যারা সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে সরকারের সিদ্ধান্তকে নিজস্ব গোষ্ঠীস্বার্থের অনুকূলে আনার চেষ্টা চালায়।

অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিকে জনগণের একটি বিশেষ অংশের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য আইনসভার সদস্য অথবা সরকারি আমলাদের উপর প্রভাব বিস্তার বা চাপ দেয়, এরূপ সংগঠনকে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বলা হয়।

যেমন : ব্যবসায়ী সংগঠন, কর্মচারী ইউনিয়ন, শিক্ষক সমিতি, লেখক ফোরাম, প্রকাশক সমিতি, শ্রমিক সংগঠন প্রভৃতি চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর আওতাভুক্ত।

একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংরক্ষণ, পরিবর্তন, গণসংযোগসাধন, জনমত গঠন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছু কিছু মিল পরিলক্ষিত হলেও উভয়ের মধ্যে উৎপত্তি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগত কিছু পার্থক্য বিদ্যমান।

রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যকার পার্থক্যগুলো নিচে উপস্থাপন করা হলো—

১। লক্ষ্যের ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে সরকার গঠন করা।

কিন্তু চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের কোনো লক্ষ্য থাকে না।

তাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করা।

২। উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য হলো বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ ও জনগণের কল্যাণ সাধন
করা।

অন্যদিকে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নিজ গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত ও পরিচালিত হয়।

৩। মতাদর্শের ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক দল একটি সুনির্দিষ্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং সেই মতাদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালায়।

আর চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কোনো মতাদর্শ নেই।

তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের কাছে গোষ্ঠীস্বার্থকে দাবি হিসেবে পেশ করে এবং তা আদায়ের চেষ্টা চালায় ।

৪। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক দল যেকোনো বিষয়ে খুব সহজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না।

বিশ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।

অন্যদিকে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়ে খুব সহজে ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

৫। সাংগঠনিক অবস্থার ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক দলের সংগঠন অনেক বড় ও শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে।

দলের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় সাংগঠনিক দিক থেকে রাজনৈতিক দল অত্যন্ত শক্তিশালী।

অপরদিকে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সংগঠন অনেক ক্ষুদ্র।

এ গোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা সীমিত এবং সাংগঠনিক দিক থেকে দুর্বল।

৬। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক দল দলীয় প্রার্থীদের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের দ্বারা দলীয় লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করে।

আর চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো অবকাশ নেই। তবে তারা পর্দার আড়ালে থেকে তাদের স্বার্থরক্ষাকারী রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে।

৭। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব উঁচু-নিচু স্তরভেদসম্পন্ন। কিন্তু চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর স্তরভেদহীন।

৮। কর্মপরিধির ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক দলের সংগঠনের মতো তাদের কর্মপরিধি বড় ও ব্যাপক ।

রাজনৈতিক দলসমূহ
তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সারা বছরই কমবেশি ব্যস্ত থাকে।

কিন্তু চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কর্মপরিধি সীমিত।

৯। কর্মপদ্ধতির ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক দলের কর্মপদ্ধতি উন্মুক্ত, প্রত্যক্ষ ও প্রচারমূলক।

ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক
`দল প্রকাশ্যে তাদের সব কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে এবং তাদের পক্ষে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

আর চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কর্মপদ্ধতি পরোক্ষ এবং তা গোপনে সম্পাদিত হয়।

১০। পেশাগত বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক দল বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায়, ধর্ম ও বর্ণের লোকের সমন্বয়ে গঠিত হয়।

তাই রাজনৈতিক দলে পেশাগত বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী এক ও অভিন্ন স্বার্থ ও মনোভাবসম্পন্ন লোকদের নিয়ে গঠিত হয় বলে পেশাগত বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয় না।

১১। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক দলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোক থাকে। এ কারণে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধ দেখা যায়।

অপরদিকে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সমস্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে বলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিরোধ কম দেখা যায়।

১২। অস্তিত্বের ক্ষেত্রে : সব ধরনের সরকারব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব লক্ষণীয়।

কিন্তু সামরিক সরকার বা একনায়কতন্ত্রে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় না।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য ও বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে মিল উভয়ই দেখা যায়।

তাছাড়া স্বল্প পরিসরে হলেও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সরকারকে বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে জনস্বার্থ সম্পর্কে জানান দেয়।