৫.৬। মৌলিক গণতন্ত্র সম্পর্কে তুমি কি জান? আইয়ুব খান কেন এটি প্রবর্তন করেছিলেন? অথবা, ১৯৫৯ সালের আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর ।

ভূমিকা : পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের শাসনামলের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হলো মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে অপসারিত করে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে মৌলিক গণতন্ত্র বা বেসিক ডেমোক্রেসি (Basic Democracy)
অন্যতম। ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে তৃণমূল পর্যায়ে প্রেসিডেন্টের নিজস্ব সমর্থক গোষ্ঠী সৃষ্টি করাই ছিল আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের মূল লক্ষ্য।

মৌলিক গণতন্ত্র : সামরিক আইন প্রশাসন থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদে সমাসীন হবার এক বছর পরে ১৯৫৯ সালের ২৭ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল বা তথাকথিত বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে আইয়ুব খান পাকিস্তানে যে নতুন ধরনের গণতন্ত্র প্রবর্তনের ঘোষণা দেন তাই ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে পরিচিত। গণতন্ত্র সম্পর্কে
আইয়ুব খানের নিজস্ব চিন্তাধারা ও বহুদিনের উদ্ভাবিত পরিকল্পনার ফলশ্রুতি ছিল মৌলিক গণতন্ত্র। জনগণের ইচ্ছাকে সরকারের কাছাকাছি এবং সরকারি কর্মকর্তাদেরকে জনগণের কাছে এনে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা করাই ছিল মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থাকে চারটি স্তরে বিভক্ত করে প্রশাসন ব্যবস্থাকে অধিকতর গণমুখী করার জন্য গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াই ছিল মৌলিক গণতন্ত্র। মৌলিক গণতন্ত্রের মূলে নিহিত রয়েছে গ্রাম। গ্রাম থেকেই এর বুনিয়াদ গড়ে উঠে বলে এই ব্যবস্থা ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্র’ নামেও অভিহিত। অধ্যাপক রাশ ব্রুক
উইলিয়ামসের মতে, “মৌলিক গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের হাতে সত্যিকার ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রথম প্রচেষ্টা।” মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল আইয়ুব খান কর্তৃক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রথম প্রয়াস। আইয়ুব খান ঘোষণা করেন যে, জনগণ যাতে নিজস্ব বিষয় পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে সে সুযোগ সৃষ্টি করাই হচ্ছে মৌলিক গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য।

মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের কারণ : মৌলিক গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার সাথে সাথে সরকারি কর্মকর্তাদের জনগণের কাছে নিয়ে আসা। মৌলিক গণতন্ত্রের অপরাপর কারণসমূহ ছিল নিম্নরূপ:

১. স্তরভিত্তিক গণতন্ত্র চালু : আইয়ুব খান উপলব্ধি করেন যে,আর্থ-সামাজিক,সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যগত
প্রভৃতি দিক থেকে পাকিস্তানে পাশ্চাত্য ধাঁচের গণতন্ত্র উপযোগী নয়। এখানে প্রয়োজন নিম্নস্তর থেকে উপরের স্তরে অর্থাৎ স্তরভিত্তিক পরোক্ষ গণতন্ত্র। এ কারণে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছিলেন।

২. জনগণের স্বনির্ভরতা : মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের কারণ সম্পর্কে আইয়ুব খান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে তিনি জনগণকে তাদের আঞ্চলিক সমস্যাসমূহের সমাধান করার জন্য সংগঠিত করতে এবং তাদেরকে আত্মনির্ভরশীল করতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এর মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক জনগণ বিশেষ করে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে গতিসঞ্চার হবে।

৩. অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা : মৌলিক গণতন্ত্রকে একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। জনগণের শিক্ষা, সচেতনতা, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বৃদ্ধি না পাওয়া পর্যন্ত এটি বা পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রাখা হবে।

৪. অভিনব ব্যবস্থা : জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে একটি অভিনব
পন্থা হিসেবে মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তিত হয়।

৫. সমন্বয়সাধন : সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়সাধনে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিশেষত (পশ্চিম পাকিস্তানের) সামরিক বাহিনী ও (পূর্ব পাকিস্তানের আমলাদের) প্রশাসনের মাঝে যোগসূত্র স্থাপনে এটি কাজ করে। এজন্য সেনাদের সিভিল সার্ভিসে ঢুকানো হয়।

৬. কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিদের যোগসূত্র : সরকারি কর্মকর্তা ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাঝে সংযোগ ও সমন্বয়সাধন করে গ্রামীণ উন্নয়নের লক্ষ্যে এ ব্যবস্থা গৃহীত হয়।

৭. ক্ষমতা সুদৃঢ়করণ : গণতন্ত্রের মুখোশ পরে আমলানির্ভর শাসন, শোষণ ও কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত করাই ছিল আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের আসল লক্ষ্য।

৮. নেতৃত্বের মেরুকরণ : মি. খান রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীন ছিলেন। তাই তাদের নিষ্ক্রিয় অকর্মণ্য রেখে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে আগ্রহী হন; যারা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি না করে বরং সহযোগিতা করবে।

৯. ধর্মীয় কারণ : শাসকবর্গ ধর্ম ব্যবহার করে ক্ষমতা আকড়ে থাকার চেষ্টা করে। আইয়ুবও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি মৌলিক গণতন্ত্রকে ইসলামসম্মত আখ্যা দিয়ে (১৫ জুন, ১৯৬০) জনসভায় বলেন, “This is the real Islamic
method of elction.” তিনি আবার বলেন, “মৌলিক গণতন্ত্রের পিছনে তার অনুপ্রেরণা হচ্ছে ইসলাম।”

১০. গণতন্ত্র কায়েম : জনগণ অজ্ঞ ও পূর্ণ গণতন্ত্রের যোগ্য নয়। এ ভুল ধারণার ভিত্তিতে মৌলিক গণতন্ত্র। রচিত হয়। তাই মধ্যবর্তী স্বার্থবাদী দল সৃষ্টি করে দেশে গণতন্ত্র কায়েমের চেষ্টা করাই ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের অন্যতম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনে আইয়ুব খানের উদ্দেশ্য ছিল একটি বশংবদ শ্রেণী তৈরি করা, যারা তার ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। তবে এ ব্যবস্থা তার শাসনকে বৈধতা দিতে সক্ষম হয়নি। এমনকি মৌলিক গণতন্ত্র নিজস্ব বৈধতাও অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। আইয়ুবের শাসনামলের শেষ দিকে মৌলিক
গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশেষ করে মৌলিক গণতন্ত্রীদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অরাজকতার বিরুদ্ধে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ ব্যবস্থার অবসান হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস PDF :

দয়া করে ১ মিনিট অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষন এর মধ্যে আপনাকে ডাউনলোড পেইজ এ নিয়ে যাওয়া হবে। আপনাকে নিয়ে যাওয়ার পর আপনাকে হবে এই পেইজে ডাউনলোড লিংক দেওয়া হবে তাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। ধন্যবাদ। আরো অন্যান্য বই গুলো নেওয়ার জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। ধন্যবাদ আপনাকে দয়া করে ১ মিনিট অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষন এর মধ্যে আপনাকে ডাউনলোড পেইজ এ নিয়ে যাওয়া হ

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related