Table of Contents
ভোক্তাবাজার বিভক্তিকরণ
উত্তর : ভূমিকা : একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে একটি পণ্যের সকল ভোক্তাদের দক্ষতার সাথে সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না বিধায় সমগ্র বাজারকে বিভিন্ন উপভাগে ভাগ করা হয়। ভোক্তাদের আয়, রুচি, ক্রয় ক্ষমতা ইত্যাদি পার্থক্যের কারণে বাজারজাতকরণ কার্যক্রম স্বচ্ছলতার সাথে পরিচালনার জন্য কয়েকটি চলকের সমন্বয়ে ভোক্তাদের বিভক্ত করতে পারে। নিচে ভোক্তাদের বিভক্তিকরণের ভিত্তিসমূহ দেখানো হলো-
(ক) ভৌগোলিক বিভক্তিকরণ (Geograhic Segmentation) :
এক্ষেত্রে একটি পণ্যের বাজারকে ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে বিভিন্ন উপবিভাগে ভাগ করা হয়। এক্ষেত্রে কোম্পানি যে চলক বা উপাদানসমূহ বিবেচনা করে তাহলো :
১. বিশ্ব অঞ্চল অঞ্চলের বিভিন্নতার কারণে ভোক্তাদের রুচি, বিশ্ব, মূল্যবোধ ও জীবন প্রণালির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য দেখা দেয়। তাই এক এক অঞ্চলে এক এক ধরনের বাজার দেখা যায়। যেমন- পূর্বাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল, পার্বত্যঞ্চল ইত্যাদি।

২. দেশীয় অঞ্চল : মহাসাগরীয় দেশ, পার্বত্য দেশ, দক্ষিণ আটলান্টিক দেশ, মধ্য আটলান্টিক দেশ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ প্রভৃতি অঞ্চলে ভোক্তাবাজারকে ভাগ করা যায়। এসব দেশীয় অঞ্চলের ভোক্তাদের প্রয়োজন, পছন্দ, অভ্যাস ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
৩. শহরের আয়তন : একটি শহরের আয়তনের ভিত্তিতে বাজারকে বিভক্ত করা যায়। যেমন- ১,০০০-এ রকম, ১০,০০০- ৫০,০০০, ৫০,০০০-এর তদূর্ধ্ব ইত্যাদি বাংলাদেশের ফা ফুডের দোকানগুলো এ পদ্ধতিতে বাজার বিভক্ত করে থাকে।
৪. ঘনত্ব এক্ষেত্রে বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ঘনত্বের ভিত্তিতে শহর, উপশহর, গ্রাম প্রভৃতি ভাগে বাজারকে ভাগ করতে পারে। যেমন- শহরের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, উপশহরের কে.জি স্কুল। গ্রামে ব্র্যাক স্কুল ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা যায়।
৫. আবহাওয়া : আবহাওয়া বা ঋতুগত কারণে একটি প্রতিষ্ঠান তার সমগ্র বাজারকে বিভক্তিকরণ করতে পারে। যেমন- গ্রীষ্মকালে ভ্যানিসিং ক্রীম, শীতকালে কোল্ড ক্রীম ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।

(খ) জনসংখ্যা বিষয়ক বিভক্তিকরণ (Demograhic Segmentation) :
জনসংখ্যা সম্পৰ্কীয় বিভিন্ন দিকগুলোর ভিত্তিকে সমগ্র বাজারকে বিভক্ত করা হয়। নিচে জনসংখ্যা সম্পর্কীয় বাজার বিভক্তিকরণের ক্ষেত্রে চলকসমূহ আলোচনা করা হল :
১. বয়স বয়সের পার্থক্যের কারণে ভোক্তার আচরণ, চাহিদা ও মূল্যবোধের পার্থক্যের জন্য / কারণে বাজারকে বিভক্ত -করা হয়। যেমন- ৫ বছরের কম, ১০-২০ বছর, ২০-৩৫, ৩৫- এর তদুর্দ্ধ। পোশাক, খেলনা, সঙ্গীত, সাবান ইত্যাদি বয়সের ভিত্তিতে বাজারজাত করা হয়।
২. লিঙ্গ : লিঙ্গ হলো একটি Demarcation line যার মাধ্যমে পুরুষ ও স্ত্রী লোকদের ভাগ করা যায়। জন্মগত কারণে পুরুষ ও মহিলার পছন্দ, চাহিদা ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যার কারণে স্ত্রী ও পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা বাজার বিভক্ত করা হয়। যেমন— পুরুষের জন্য সেলুন, স্ত্রীদের জন্য সেলুন ইত্যাদি।
৩. পরিবারের আয়তন : ছোট পরিবার ও বড় পরিবারের জন্য বাজার বিভক্ত করা হয় ছোট পরিবারে আমোদ-প্রমোদ বেশি থাকে। ১-২ জন পরিবার ৫-৭ জন, ৭-এর অধিক ইত্যাদি যেমন পরিবারের আয়তনের কারণে মোলা লবণ ৫০০ গ্রাম, ১ কেজি হয়ে থাকে।
৪. পারিবারিক জীবনচক্র: পরিবারের জীবিকা নির্বাহের উপর ভিত্তি করে বাজার বিভক্তিকরণ করা হয়। কারণ জীবন ধাঁচের পার্থক্যের কারণে তাদের চাহিদা, পছন্দ ইত্যাদি বিভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন-ফার্নিচার কোম্পানিগুলো যুবকদের উদ্দেশ্যে Single box বিবাহিতদের জন্য Double box খাট বাজারজাত করে থাকে।
৫. আয় : মানুষের আয় বৃদ্ধি বা হ্রাসের সাথে সাথে চাহিদা ও পছন্দ ইত্যাদির ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা দেয়। তাই মানুষের আয়ের ভিত্তিতে বাজার বিভক্তিকরণ করা হয়। যেমন-বি.এ.টি.সি কোম্পানি তার সিগারেট আয়ের ভিত্তিতে বাজারে উপস্থাপন করছে। যেমন-গোল্ডলিফ ২ টাকা, ৫৫৫-৩ টাকা, বেনসন-৪ টাকা ইত্যাদি।

৬. পেশা পেশার বিভিন্নতার কারণে ভোক্তাদের চাহিদা, রুচি, পছন্দের ক্ষেত্রে তারতম্য লক্ষ করা যায়। যার জন্য পেশার ভিত্তিতে বাজারকে বিভক্ত করা হয়। যেমন- কৃষক, শ্রমিক, চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, উকিল, প্রকৌশলী ইত্যাদি পেশার মানুষের জন্য আলাদা আলাদা বাজার নির্বাচন করা হয়।
৭. শিক্ষা : প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, ঘাতক, ঘাতকোত্তর ইত্যাদি মানুষের শিক্ষান্তরের মানুষের মনোভাব, ভোগ প্রবণতার পার্থক্যের কারণে বাজারকে বিভক্তিকরণ করা হয়। শিক্ষার স্তর বিবেচনা করে বাজার বিভক্ত হয়। যেমন- উচ্চ শিক্ষিতের জন্য ইংলিশ ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন, অল্প শিক্ষিতদের জন্য বাংলা ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন, শিক্ষকদের জন্য রেডিওতে বিজ্ঞাপন ইত্যাদির মাধ্যমে পণ্য উপস্থাপন করা হয়।
৮. ধর্ম : বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ইত্যাদিতে পার্থক্য থাকার কারণে বাজারকে বিভক্ত করা হয়। তামাক, মদ, কফি, মাংস ইত্যাদি ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেমন- মুসলিম ধর্মে গোমাংস খাওয়া ঠিক হলেও হিন্দুদের জন্য তা নিষিদ্ধ
৯. বর্ণ : সাদা, কালো, শিয়া, সুন্নি, উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ প্রভৃতি বিভিন্ন বর্ণের মানুষের ভোগ প্রবণতায় পার্থক্যের ভিত্তিতে বাজার বিভক্তিকরণ করা হয়। যেমন—খাদ্য, পোশাক, সঙ্গীত, ব্যাংকিং, বীমা প্রভৃতি পণ্য বা সেবার বাজার বর্ণের ভিত্তিতে ভাগ করা যায় ।ফলে জাতীয়তার ভিত্তিতে আমাদা বাজার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।ভোক্তাবাজার বিভক্তিকরণ
(গ) মনস্তাত্ত্বিক বিভক্তিকরণ (Psychograhic Segmentation) :
ভোক্তাদের মনস্তাত্ত্বিক কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেও ভোক্তা বাজারকে ভাগ করা যায়। যেমন-
১. সামাজিক শ্রেণী : কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে সামাজিক শ্রেণীর ভিত্তিতে বাজারকে বিভক্তিকরণ করা যায়। যেমন- নিম্নবিত্ত শ্ৰেণী, উচ্চবিত্ত শ্রেণী, শ্রমিক শ্রেণী, মধ্যবিত্ত শ্রেণী ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে পোশাক, গাড়ি প্রভৃতি বাজারজাত করা হয় ।
২. জীবন ধাঁচ : সমাজে বসবাসরত মানুষের জীবন ধাঁচের ভিত্তিকেও বাজার বিভক্তিকরণ করা যায়। কারণ যে ব্যক্তির জীবন ধাঁচ যত উন্নত পণ্যের প্রতি তার আগ্রহ বেশি থাকে। যেমন- CATSEYE বিভিন্ন ধরনের জীবন ধাঁচ অনুযায়ী নিত্য নতুন পণ্য সরবরাহ করছে।
৩. ব্যক্তিত্ব : মানুষের ব্যক্তিত্ব দ্বারাই তার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন যেমন-স্বাধীনচেতা, রক্ষণশীল, সঙ্গলি, কর্তব্যপরায়ণ প্রভৃতি মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনা, ভোগ অভ্যাস ইত্যাদির ক্ষেত্রে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। প্রসাধনী, সিগারেট, পানীয় প্রভৃতি বাজারকে ব্যক্তিত্বের ভিত্তিতে বিভক্তিকরণ করা যায় ।
(ঘ) আচরণিক বিভক্তিকরণ (Behaviowal Segmentation) : বিভিন্ন ভোক্তাদের পণ্য সম্পর্কে জ্ঞান মনোভাব পণ্য থেকে প্রত্যাশিত সুবিধা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায় বলে অনেক বাজারজাতকারী পণ্যের বাজারকে আচরণের ভিত্তিতে বিভক্তিকরণ করে থাকে। নিচে ভিত্তিসমূহ আলোচনা করা হল :
১. উপলক্ষ্য ক্রেতাদের নিকট পণ্যের প্রয়োজনীয়তা ব্যবহারের সময় অথবা ক্রয়ের বিভিন্ন উপলক্ষ্যের উপর বিমান ভ্রমণ নির্ভর করে।
২. প্রত্যাশিত সুবিধাবলী : ভোক্তারা পণ্য থেকে কি ধরনের সুবিধা প্রত্যাশা করে তার উপর ভিত্তি করে অনেক সময় বাজারকে বিভক্তিকরণ করা হয়ে থাকে।
৩. ব্যবহারকারী মর্যাদা কোন ব্যক্তি কোন পণ্য কখনো : ব্যবহার করে না। পূর্বে ব্যবহার করেছে ভবিষ্যতে ব্যবহার করতে পারে, প্রথমবারের মত ব্যবহার করছে বা নিয়মিত ব্যবহার করছে এসব বিষয় বিবেচনা করে সমগ্র বাজারকে বিভক্তিকরণ করা হয়।
৪. ব্যবহারের হার : ক্রেতাদের ক্রয়ের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে এ বিভক্তিকরণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে ক্রেতাদেরকে ছোট/ক্ষুদ্র, মাধ্যম/মাঝারি, বৃহৎ/বড় ও অব্যবহারী এভাবে ভাগ করা হয়।

৫. আনুগত্য মর্যাদা : কোন পণ্য, সেবা, দোকান, ব্র্যান্ড বা কোম্পানির প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে বাজারকে বিভক্তিকরণ করা যায়। কেউ সম্পূর্ণ আনুগত্য আবার কেউ কম আনুগত্য, যারা সম্পূর্ণ আনুগত্য তারা একটি ব্র্যান্ড সব সময় ক্রয় করে। আর, যাদের মোটামুটি বা কম আনুগত্য থাকে তারা দুই-তিনটা পণ্যের প্রতি আসক্ত থাকে ।
৬. প্রস্তুতির পর্যায় : কোন ব্যক্তি হয়তো পণ্য সম্পর্কে কিছুই জানে না, কেউ হয়তো পণ্য সম্পর্কে সচেতন, কেউ হয়তো অসচেতন, কেউ হয়তো জ্ঞাত, কেউ পণ্যটি চায়, কেউ আগ্রহী ইত্যাদি বিভিন্ন স্তর বিবেচনা করে পণ্যের বাজারকে বিভক্ত করা যায়।
৭. পণ্যের প্রতি মনোভাব : ভোক্তাবাজার বিভক্তিকরণ কোন একটি পণ্য সম্পর্কে ক্রেতাদের বিভিন্ন ধরনের মনোভাব থাকতে পারে। যেমন- উৎসাহমূলক, ইতিবাচক, নিরপেক্ষ, নেতিবাচক ও বৈরি ইত্যাদি । তাই সমগ্র বাজারকে মনোভাবের ভিত্তিতে ভাগ করতে হয়।
উপসংহার: উপরোক্ত উপাদান বা চলকগুলোই ভোক্তা বাজার বিভিক্তিকরণের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে কোন বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই সবগুলো উপাদানকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা সম্ভব নয়।