১২ প্রশ্ন : ২.৮। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ অথবা, ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের প্রধান প্রধান ধারাগুলো কি ছিল তা লিখ

উত্তর : 

ভূমিকা : 

ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের গতিধারায় ১৯৪৭ সালের ভারত শাসন আইন ভারতীয়দের জাতীয় জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা । তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মি. এটলির ঘোষণা মোতাবেক ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভারতবর্ষকে বিভক্তির মাধ্যমে ভারতীয় শাসন পরিকল্পনায় যে সমস্ত সুপারিশ করেন সেগুলোকে সামনে রেখে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের জনগণের স্বাধীনতা প্রদানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয় এবং এ আলোকেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই কতিপয় ধারা সংবলিত ভারত শাসন আইন পাস করে । এই আইন অনুসারে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং পৃথিবীর মানচিত্রে অখণ্ড ভারতের পরিবর্তে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে ।

 

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের ধারাসমূহ : 

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন ছিল ভারতবাসীর সুদীর্ঘ সময়ের সংগ্রামী ফসল । এই আইনের প্রধান প্রধান ধারা

বা বৈশিষ্ট্যসমূহ ছিল নিম্নরূপ :

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান :

 ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ভারতবর্ষের উপর ব্রিটিশ সরকার ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব ও প্রভুত্বের অবসান ঘটায়। আর এর মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে প্রায় দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের যবনিকাপাত ঘটে ।

 দুটি ডোমিনিয়ন প্রতিষ্ঠা : 

এ আইনানুসারে ব্রিটিশ ভারতকে বিভক্ত করে পাকিস্তান ও ভারত ইউনিয়ন নামে দুটি সম্পূর্ণ স্বাধীন ডোমিনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা হয় । ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববাংলা, পশ্চিম পাঞ্জাব, উত্তর সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, আসামের কাছাড় ও তৎকালীন সিলেট জেলার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা এবং যে সকল দেশীয় রাজা পাকিস্তান ইউনিয়নে যোগদানে ইচ্ছুক তাদের সমন্বয়ে ‘পাকিস্তান’ গঠিত হবে। অন্যদিকে ব্রিটিশ ভারতের অবশিষ্টাংশ ও ভারত ইউনিয়নে যোগদান করতে ইচ্ছুক, দেশীয় রাজ্যগুলোর সমন্বয়ে ‘ভারত ইউনিয়ন’ গঠিত হবে ।

 সার্বভৌম গণপরিষদ : 

এই আইনে দুই ডোমিনিয়নের জন্য সার্বভৌম গণপরিষদ গঠনের ব্যবস্থা করা হয় । গণপরিষদ দুটি স্ব-স্ব ডোমিনিয়নের সংবিধান রচনা করবে বলে ঘোষিত হয় ।

ডোমিনিয়ন ও কমনওয়েলথ সম্পর্ক :

 পাকিস্তান ও ভারত ডোমিনিয়নদ্বয় ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশ হিসেবে থাকবে কি থাকবে না সে সম্পর্কে স্ব-স্ব ডোমিনিয়নের গণপরিষদকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয় ।

ভারত সচিব পদের বিলুপ্তি :

 এ আইনে ভারত সচিবের পদ বিলুপ্ত করা হয় এবং পাকিস্তান ও ভারত নামক ডোমিনিয়নের মধ্যে সংযোজন স্থাপনের জন্য ‘ব্রিটিশ কমনওয়েলথ’ সচিবের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয় ।

ভারত সম্রাট উপাধির বিলোপ সাধন : 

এ আইনের দ্বারা রাজকীয় মর্যাদা এবং ইংল্যান্ডের রাজার উপাধি হতে ‘ভারত’ উপাধি বিলুপ্ত করা হয় ।

রাজার আইন নাকচ করার ক্ষমতা:

 এই আইন ভারত শাসনে ইংল্যান্ডের রাজার আইন নাকচ করার ক্ষমতা এবং তার অনুমোদনের জন্য আইন সংরক্ষণ করার নীতির অবসান ঘটায় ।

দেশীয় রাজ্যগুলোর উপর রাজার সার্বভৌম ক্ষমতা প্রত্যাহার :

 এই আইনে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে দেশীয় রাজ্যগুলোর উপর রাজার সার্বভৌম ক্ষমতার অবসান ঘটে । দেশীয় রাজ্যগুলোকে উক্ত আইনে স্বাধীন থাকার অথবা ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো ডোমিনিয়নে যোগদানের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এ আইন দেশীয় রাজ্যগুলোর সাথে ব্রিটিশ সরকারের পূর্বেকার সকল চুক্তিরও অবসান ঘটায় ।

ভারতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উপজাতি সমস্যা : 

উত্তরাধিকারী ডোমিনিয়ন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উপজাতিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে ঘোষিত হয় ।

সিভিল সার্ভিস প্রসঙ্গ :

 ভারত স্বাধীনতা আইনের ১০নং ধারানুযায়ী ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে নিযুক্ত কর্মচারীরা ১৫ আগস্টের পর নূতন ডোমিনিয়নদ্বয়ের সরকারের অধীনে চাকরি করতে রাজি থাকলে তারা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পূর্বের ন্যায় সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে ।

 

 ১৯৩৫ সালের আইনের সাংবিধানিক মর্যাদা ও সংশোধন : 

ডোমিনিয়নদ্বয়ের গণপরিষদ কর্তৃক স্ব-স্ব ডোমিনিয়নের শাসনতন্ত্র রচিত না হওয়া পর্যন্ত ডোমিনিয়নদ্বয়ের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলো নিম্নলিখিত পরিবর্তন ও সংশোধন সাপেক্ষে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনানুযায়ী শাসিত হবে । যথা—

 

 গভর্নর জেনারেলের নিয়োগ :

প্রত্যেক নতুন ডোমিনিয়নের একজন গভর্নর জেনারেল, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শক্রমে ব্রিটিশরাজ কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং তিনি ডোমিনিয়ন সরকারের পক্ষে ব্রিটিশ রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করবেন । উভয় ডোমিনিয়ন আইন পরিষদ কর্তৃক ভিন্ন রূপে ব্যবস্থা না হলে একই ব্যক্তি উভয় ডোমিনিয়নের গভর্নর জেনারেল পদ গ্রহণ করতে পারবেন ৷

প্রাদেশিক গভর্নর নিয়োগ :

 সংশ্লিষ্ট ডোমিনিয়নের মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শক্রমে গভর্নর জেনারেল প্রাদেশিক গভর্নরকে নিয়োগ করবেন ।

 গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরের ক্ষমতা হ্রাস : 
 

গভর্নর জেনারেল ও প্রাদেশিক গভর্নরের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বিচার-বুদ্ধিজনিত ক্ষমতা এবং বিশেষ দায়িত্বজনিত ক্ষমতানুযায়ী কাজ করার ক্ষমতার অবসান ঘটবে । অধিকন্তু সকল বিষয়ে এবং সব অবস্থায় গভর্নর জেনারেল ও প্রাদেশিক গভর্নর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শানুযায়ী সকল প্রকার কার্য করতে বাধ্য থাকবেন ।

 ডোমিনিয়নের আইন পরিষদের আইনের বৈধতা :
 

 ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইনের সাথে ডোমিনিয়নদ্বয়ের আইন পরিষদ কর্তৃক প্রণীত আইন সামঞ্জস্যহীন হলেও ডোমিনিয়নদ্বয়ের আইন পরিষদ কর্তৃক প্রণীত আইনকে অচল কিংবা বাতিল বলে গণ্য করা হবে না ।

উপসংহার :

 পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন ভারতবর্ষের জনগণের জন্য বয়ে নিয়ে আসে স্বাধীনতার এক প্রস্ফুটিত সৌরভ। বস্তুত ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার যে স্পৃহা ফুটে উঠে, পরবর্তীকালে বিভিন্ন আন্দোলন, ঘাত-প্রতিঘাত, পর্যায় ও প্রক্রিয়ায় ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনে তার অপ্রতিরোধ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এর ফলে ভারতবর্ষে প্রায় দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের অবসান ঘটে এবং ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত নামে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে । সেই সাথে উপমহাদেশের জনগণের কৃষ্টি, সভ্যতা, সাহিত্য, জীবনযাত্রার প্রণালি ও রাজনৈতিক চিন্তাধারায় সূচিত হয় আরেকটি নব অধ্যায় ।

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related

ক্লাস ৭ বিজ্ঞান গাইড ২০২৫ পিডিএফ ডাউনলোড: পরীক্ষার প্রস্তুতিতে এক নতুন দিগন্ত

শিক্ষার্থীদের জন্য সঠিক গাইড এবং নোট পাওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম,...

Class 7 তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি Guide Book PDF 2025 Download – Lakhokonthe Education

আজকের ডিজিটাল যুগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT) একটি...

Class 7 গণিত Guide Book PDF 2025 Download – Lakhokonthe Education

গণিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা প্রতিটি শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য...

Class 7 ইংরেজি ২য় পত্র Guide Book PDF 2025 – সহজে ডাউনলোড করুন Lakhokonthe Education ওয়েবসাইট থেকে

বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস – সকল বিষয়ই ছাত্রদের...