বিশ্বায়ন ও নাগরিক অধিকার কি?

পাঠ-৫.২ : বিশ্বায়ন ও নাগরিক অধিকার Globalization and Rights of Citizen:

বিশ্বায়ন হলো পারস্পরিক ক্রিয়া এবং আন্তঃসংযোগ সৃষ্টিকারী এমন একটি পদ্ধতি যা বিভিন্ন জাতি, সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের মধ্যে সমন্বয়ের সূচনা করে।

বর্তমান বিশ্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক বহুল আলোচিত বিষয় হচ্ছে বিশ্বায়ন।

বিশ্বায়ন শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Globalization. বিশ্বায়ন শব্দের অর্থ হলো বিশ্বকে একীভূত করা।

এটি সর্বব্যাপী ও সার্বক্ষণিক চলমান প্রক্রিয়া। তথ্যপ্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসারের ফলে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষই একটি একীভূত অবস্থায় মিলিত হচ্ছে।

ক্রমেই ভৌগোলিক সীমারেখা বিলীন হয়ে বিভিন্ন দেশের মানুষ আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে পরস্পর কাছাকাছি আসছে।

বিশ্বায়নের বিকাশ : বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো শিল্পোন্নত দেশ থেকে শুরু করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশ্বায়নের ঢেউ এসে লেগেছে।

সে কারণেই বিশ্বায়নের সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। বিশ্বায়ন বিশ্বব্যাপী সব সমাজ ও অর্থব্যবস্থার মধ্যে সংহতি বজায় রাখার এমন এক প্রক্রিয়া নির্দেশ করে, যা একই প্রকার উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদনব্যবস্থায় আস্থাশীল।

আধুনিক পুঁজিবাদ হচ্ছে এর মূল চালিকাশক্তি।
প্রকৃতপক্ষে বিশ্বায়ন বলতে বোঝায়, পুঁজি, অর্থ, সম্পদ ও প্রযুক্তির এক স্থান থেকে অপর স্থানে চলাচল।

অর্থাৎ বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে উৎপাদনের যেকোনো উপাদান অবাধে চলাচলের সুযোগ লাভ করবে।

ফলে সংকুচিত হবে বিশ্বের পরিধি, বিশ্ব পরিচিতি পাবে গ্লোবাল ভিলেজ (Global Village) হিসেবে।

বিশ্বায়নের মূলকথা হলো বাণিজ্যনীতি বা কৌশল অবলম্বন। অর্থাৎ, এক দেশের বাণিজ্য অপর দেশের বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হওয়ার কিংবা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো রকম বাধা-নিষেধ আরোপিত না হওয়ার যে প্রক্রিয়া সেটিই হচ্ছে বিশ্বায়ন ।

বিশ্বায়নের প্রবক্তাগণের মতে, দ্রুত বিশ্বায়নের মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জীবনযাত্রার দ্রুত মানোন্নয়ন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সবই সম্ভব।

বিশ্বায়নের অপর একটি পরিচিত দিক হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি ।

বিশ্বায়নের সংজ্ঞা : বিশ্বায়নকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে Rosabeth Moss Kanter বলেন,

“The World is becoming a global shopping mall in which ideas and products are available everywhere at the same time.”

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আইয়ুবুর রহমান ভূঁইয়া
(Ayubur Rahman Bhuiyan) বলেন, “Globalization means trade liberalization such as deregulation, privatization and free trade in the global economy.”

অর্থাৎ, “বিশ্বায়ন বলতে বাণিজ্য উদারীকরণ যেমন- নিয়ন্ত্রণমুক্তকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে মুক্ত ও অবাধ বাণিজ্যকে বোঝায়।”

Advance Learner’s Dictionary অনুযায়ী— “বিশ্বায়ন হচ্ছে এমন এক বাস্তবতা যার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো একে অপরের সাথে যুক্ত হচ্ছে; যা বড় ধরনের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এবং উন্নতমানের যোগাযোগব্যবস্থার প্রভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।”

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ ২০০০ সালে বিশ্বায়ন সম্পর্কে চারটি মৌলিক দিক প্রকাশ করেছে।

খেল হলো- ১. বাণিজ্য ও বিনিময় করা,
২. পুঁজি ও বিনিয়োগের অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা করা, ৩. দেশান্তর ও মানুষের বিশ্বায়নের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ম্যাকক্ষ বলেন,
“বিশ্বায়নকে বলা হয় আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্গত বিভিন্ন বই ও
চলাচলের ব্যবস্থা করা, ৪. জ্ঞানের প্রসার করা।

সমাজের মধ্যে বহুবিধ সংযোগ ও সম্পর্কের নিমিত্তকে। ”

বিশ্বায়ন সম্পর্কে Martin Albrow তাঁর ‘Introduction to Globalization’ গ্রন্থে বলেন,

“বিশ্বায়ন হলো একটি
সামগ্রিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সমগ্র বিশ্ববাসীকে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া।”

Marshal MacLohan, “Globalization is the converted image of global village ideology.” “Global Village-এর পরিবর্তিত রূপই হলো বিশ্বায়ন।”

উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, বিশ্বায়ন হলো বিশ্বকে একীভূত করা।
এটি জাতীয় ধারণাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচয় করে দিয়েছে।

বিশ্বায়নের সাথে নাগরিক অধিকার
বিশ্বায়ন বর্তমানে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।

বিশ্বায়নের ফলে সার্ক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ইত্যাদি গঞ্জে উঠেছে; যার মাধ্যমে আঞ্চলিক রাজনীতি আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছে।

ফলে আঞ্চলিক বা জাতীয় রাজনীতি থেকে অনেক সমস্যা দূরীভূত হয়েছে।
বিশ্বায়ন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এনেছে অভাবনীয় পরিবর্তন।

বিশ্বায়নের ফলে সৃষ্ট স্যাটেলাইট, টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশে প্রবেশ করছে।

মূলত এর মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতি, মূল্যবোধ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে।
সাম্যের অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার, ভোটদানের অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার ইত্যাদি অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের ভূমিকা অপরিসীম।

বিশ্বায়নের ফলে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান নাগরিক অধিকার বা মানবাধিকার নিয়ে তদারকি করে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকগণ তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ফলে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের মুখোমুখি হচ্ছে।

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নাগরিক আন্দোলন হয়েছে এবং সিরিয়ায় নাগরিক আন্দোলন চলছে।

বিশ্বায়নের কারণে আজ নাগরিকের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপ্তি ঘটেছে।

এটি দেশীয় সীমানা পার হয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্থান করে নিয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের জন্য মানুষ ঘরে বসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবাধিকার সম্পর্কে নিজের মতামত অবাধে প্রকাশ করতে পারছে।

তবে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনকানুন মেনে মন্তব্য করতে হয়।

বিভিন্ন দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে মানুষ খুব সহজে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছে, যা অতীতে এত সহজে কল্পনা করা যেত না।

শিক্ষা লাভের অধিকার নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার। বিশ্বায়নের ফলে কোনো দেশের নাগরিক নিজ দেশের শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি বিশ্বের উন্নত দেশে শিক্ষা লাভের সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে।

নাগরিকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরস্পর সহযোগিতা করছে।

চিকিৎসা সম্ভব না হলে প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য নাগরিকগণ অন্য দেশে যেতে পারে।

আমাদের দেশ থেকে স্বাস্থ্য সব সুখের মূল। এই স্বাস্থ্য রক্ষা নাগরিকের একটি মৌলিক অধিকার।

নিজ দেশে কোনো জটিল রোগের বহু নাগরিক আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভারতে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যায়। বিশ্বায়নের আশীর্বাদ।

এটি মানুষের জন্য খেলাধুলা, বিনোদন বর্তমান বিশ্বের একটি অন্যতম পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যম।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়গণ বাংলাদেশে ক্রিকেট, ফুটবল, হকিসহ বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করতে আসেন।

তেমনি বাংলাদেশের খেলোয়াড়গণও এসব খেলায় অংশগ্রহণ করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যান। এতে ওই সব দেশের সাথে আমাদের


সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। খেলোয়াড়গণ বিভিন্ন টুর্নামেন্টে পুরস্কার লাভ করে নিজের ও দেশের সুনাম বৃদ্ধি করছেন।

নাগারিকগণ নিজ যোগ্যতাবলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন খেতাব, পুরস্কার নিতে পারে। যেমন : নোবেল পুরস্কার, চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আরও নানা পুরস্কার।

এছাড়া আমেরিকা, ব্রিটেন, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভুটান, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সৌদি আরব, কাতার, ইরাক, ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নাগরিকগণ চাকরি করছে, যা সম্ভব হয়েছে বিশ্বায়নের বদৌলতে।

বাংলাদেশেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকগণ চাকরি ও ভ্রমণ করার উদ্দেশ্যে আসে।

এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের সংস্কৃতির আদান-প্রদানের সাথে সাথে অর্থনৈতিক উন্নতিও হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ব্যবসা করছে।

বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— বাটা, টাটা, ইউনিলিভার, সনি, ফিলিপস ইত্যাদি।

বাংলাদেশের বহু ব্যবসায়ীও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসায় করছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার দখল করে আছে।

বিশ্বায়নের মূলমন্ত্রই হলো Convergence বা বৈচিত্র্যকে লুপ্ত করে একটি মাত্র ছাঁচে বিশ্বকে ঢেলে সাজানো।

তাই বিশ্বের পাঁচতারা হোটেলগুলো, বড় বড় নগরী, ধনিক শ্রেণির পোশাক, খাদ্য, রাজনীতি এমনকি মানসিক সম্পর্কেও যেন কোনো ভেদাভেদ নেই।

অপরদিকে নাগরিক অধিকার যেমন : শিক্ষা, চিকিৎসা, উৎপাদন, চিন্তা-চেতনা এবং বিশ্ব পরিচিতির পথকে বেগবান করছে বিশ্বায়ন।
তাই বিশ্বায়নকে বহুপক্ষীয় বলা যায় ।