প্রশ্ন : ৩। প্রাচীন বাংলার জনপদসমূহের নাম লিখ। অথবা, বাংলার প্রাচীন জনপদগুলাের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। অথবা, সংক্ষেপে বঙ্গ ও পঞ্জ জনপদ সম্পর্কে লিখ। |
বাংলার জনপদ
প্রাচীন যুগে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। বাংলাদেশ বলতে পরবর্তীকালে (যেমন- মুসলমান আমলে) যে ভূখণ্ডকে বুঝাত তা প্রাচীনকালে কতগুলাে খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত ছিল। পশ্চিমবঙ্গে বাট ও তামলিপ্তি, পুর্ববঙ্গে বঙ্গ, সমতট, হরিকেল ও বঙ্গাল, উত্তরবঙ্গে পুণ্ড ও বরেন্দ্র নামে কয়েকটি পৃথক রাজ্য। ছিল। এ কাজগুলােই তখনকার দিনে জনপদ নামে পরিচিত ছিল। তাছাড়া বর্তমান উত্তরবঙ্গের একাংশ ও পশ্চিমবঙ্গের। কতক অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছিল গৌড় রাজ্য। এটিও প্রাচীন বাংলার একটি জনপদ।
বিভিন্ন জনপদের পরিচয় : নিতে প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন জনপদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলাে :
১. গৌড় : বাংলার ইতিহাসে গৌড় নামটি ছিল অতি প্রাচীন। তবে গৌড় জনপদটি বাংলার কোন অংশে অবস্থিত ছিল। তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। ধারণা করা হয় যে, ষষ্ঠ শতাব্দীতে পশ্চিম বাংলার উত্তরাংশে ও উত্তরবঙ্গে যে স্বাধীন রাজ্য। প্রতিষ্ঠিত হয় তাই গৌড় রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী কর্ণসুবর্ণ ছিল তখন গৌড় রাজ্যের রাজধানী।
২.বঙ্গ: উপমহাদেশের একটি প্রাচীন দেশ। বহু প্রাচীন গ্রন্থে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বঙ্গ নামের উৎপত্তি সম্পর্কেে ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে। আইন-ই-আকবরী’ প্রণেতা আল ফজলের মতে, বাংলাদেশের প্রাচীন নাম ছিল ‘বঙ্গ’ ।
বঙ্গ’ ও ‘আল’ এই ‘দুটি কথার সংমিশ্রণে ক্রমে বাঙ্গালা নামের উৎপত্তি হয়েছে ।
বাঙ্গালা দেশের নাম থেকেই বাংলা বা বাঙ্গালা নামের উৎপত্তি হয়েছে। ঐতিহাসিক ডক্টর রমেশ মজুমদারের মতে, বাঙ্গালা দেশের নাম থেকেই বাংলা বা বাঙ্গালা নামের উৎপত্তি হয়েছে ।
৩ পুণ্ড্র: একটি প্রাচীন জাতিমলক নাম। মহাভারতের দিগ্বিজয় পর্বে বলা হয়েছে- এ পুণ্ড্র জাতি আধুনিক মুঙ্গেরের পূর্বদিকে বসবাস করতাে, রাজত করতে কোশী নদীর উপকলে । বর্তমানে পণ্ড রাজ্য উত্তরবঙ্গের বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলা নিয়ে গঠিত ছিল । পণ্ড নগর ছিল প্রাচীন পুণ্ড্র রাজ্যের রাজধানী।
৪. বরেন্দ্র : বরেন্দ্র উত্তরবঙ্গের একটি প্রসিদ্ধ অঞ্চল। এটি পুণ্ড্র রাষ্টেরই অংশবিশেষ। এ অঞ্চলের অবস্থান সম্পর্কে সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে’ বলা হয়েছে, গঙ্গা আর করতােয়ার মধ্যে যে ভূখণ্ড, বরেন্দ্র ছিল তারই নাম। তাবাকাত-ইনাসিরী নামক গ্রন্থে এটি গঙ্গা নদীর পূর্বভাগে অবস্থিত লক্ষ্মণাবতী রাজ্যের অংশ বলে বর্ণিত হয়েছে।
৫. রাঢ় : জৈন গ্রন্থ ‘আচারঙ্গ সূত্রে’ রাঢ়ের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত . ছিল। এ অঞ্চলের অধিবাসীগণ মােটামুটিভাবে গঙ্গার দক্ষিণ ও পশ্চিম ভাগে বসবাস করতাে। এ সময় রাঢ় দেশ দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল । যথা– সূক্ষ্মভূমি ও বজ্রভূমি। প্রাচীন রাঢ়ের রাজধানী ছিল কোটিবর্ষ।
৬. সমতট : সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভগাত্রে খােদিত লিপিতে এই নামের জনপদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় । ষষ্ঠ শতকে রচিত পুঁথি বৃহৎ সংহিতায়’ পৃথকভাবে এ জনপদের উল্লেখ আছে। এটি বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলকে নিয়ে গড়ে উঠে।
৭. হরিকেল : চীনা পরিব্রাজক ইৎ সিং-এর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হরিকেল ছিল পূর্ব ভারতের প্রান্তসীমায় ।। পূর্ববাংলার চন্দ্র রাজবংশের সময় থেকেই হরিকেলকে বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। হেমচন্দ্র হরিকেলকে বঙ্গের সঙ্গে অভিন্ন বলে উল্লেখ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত দুটি পাণ্ডুলিপি থেকে হরিকেলকে সিলেটের সঙ্গে সমার্থক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ হরিকেলকে বঙ্গের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেছেন।
৮. তাম্রলিপ্তি : মহাভারতে ভীমের দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে প্রাচীন বাংলার প্রসিদ্ধ জনপদ হিসেবে তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে তাম্রলিপ্তি জনপদ অন্যান্য জনপদ থেকে স্বতন্ত্রভাবে উল্লিখিত হয়েছে। আবার কখনাে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে দণ্ডভুক্তি জনপদ হিসেবে। বর্তমান মেদিনীপুর জেলার তমলুক এলাকাই ছিল তাম্রলিপ্তি জনপদের কেন্দ্রস্থল।
পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলিম শাসনের পূর্বে বাংলায় কতিপয় প্রসিদ্ধ ও সমৃদ্ধিশালী জনপদ গতে উঠে। এসব জনপদ পরবর্তীতে সম্ভবত গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর এক নামে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। তাছাড়া বাংলার বিভিন জনপদ তার পুরাতন ভৌগােলিক ও রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য বিলােপ করে বঙ্গের সাথে একীভূত হতে থাকে এবং বঙ্গ বা বাংলা নামে পরিগণিত হতে থাকে।
বাংলার প্ৰাচীন জনপদসমূহ wiki