বলপ্রয়োগ মতবাদ

বলপ্রয়োগ মতবাদ

(Doctrine of Force)

বলপ্রয়োগ মতবাদের মূলকথা হচ্ছে, সবলরা দুর্বলদেরকে দৈহিক শক্তিবলে অধীনস্থ করে তাদের ওপর আইনকানুন চাপিয়ে আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য করে রাষ্ট্র গঠন করেছে।

প্রাচীনকালে মানুষ ছোট ছোট গোত্রে বিভক্ত হয়ে বসবাস করত। তখন আন্তঃগোষ্ঠীয় সংঘাত প্ৰায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। পরাজিত গোষ্ঠী বিজয়ী গোষ্ঠীর অধীন হতো।

বিজয়ী গোষ্ঠীর প্রধানের শাসন তারা মানতে বাধ্য হতো। পরবর্তীতে অন্যান্য গোষ্ঠীও পরাজিত হয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠীর অধীন হতো।

এভাবে বৃহৎ জনগোষ্ঠী ও এলাকা শক্তিশালী গোষ্ঠীর অধীনস্থ হয়ে রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি পেত ।

ডেভিড হিউম, জেংকস জেলেনিক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলপ্রয়োগ মতবাদের সমর্থক।

লেংকস বলেন, “ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, আধুনিক সব রাষ্ট্রব্যবস্থা সার্থক রণকৌশলের ফলশ্রুতি।”

জেলেনিকের মতে, “শক্তিশালী নেতা তার অনুগামী যোদ্ধাদের সহায়তায় যখন চলনসই নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ওপর স্থায়ী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে তখনই রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে।”

বলপ্রয়োগ মতবাদের আসল কথা বলপ্রয়োগের ফলে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে এবং শক্তি প্রয়োগ দ্বারা তা টিকে থাকবে।

.প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে এ মতবাদের প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। গ্রিক বীর আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, চেঙ্গিস খাঁ, সম্রাট আকবর প্রমুখ রাজা-বাদশাহ সম্রাটদের যুদ্ধ ও রাজ্যজয়ের কাহিনিতে ইতিহাস সমৃদ্ধ ।

ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ শক্তি প্রয়োগ মতবাদে বিশ্বাসী। ম্যাকিয়াভেলি, হিউম, জেংকস প্রমুখ তাদের বক্তব্যে এ মতবাদ সমর্থন করেছেন। কার্ল মার্কস এবং ম্যাক্স ওয়েবারও বলপ্রয়োগের গুরুত্বকে স্বীকার করেছেন।

কার্ল মার্কসের মতে, দাস সমাজব্যবস্থা, সামস্ত সমাজব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ভূমির মালিক এবং উৎপাদনের উপকরণগুলোর মালিক সবসময় চেষ্টা করতেন তাদের সম্পদ ও ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য।

এজন্য প্রয়োজন একটি সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান। এজন্যই তারা অতীতে নিজ স্বার্থেই রাষ্ট্র গঠন করেছে এবং তা পরিচালনার জন্য সরকার
গঠন করেছে।

কার্ল মার্কস বল বা শক্তির কথা স্বীকার করেছেন। বল বা শক্তি প্রয়োগ করে সম্পদশালী ব্যক্তিরা যেমন রাষ্ট্র ও সরকারকে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত করেছে তেমনই শক্তি বা বলপ্রয়োগ করেই তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে এবং শ্রেণিহীন সমাজ গঠন করতে হবে।

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারও বিশ্বাস করেন যে, বল বা শক্তিই হচ্ছে রাষ্ট্র শক্তির মূলভিত্তি। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং টিকে রয়েছে বল বা শক্তি প্রয়োগ ক্ষমতা দ্বারাই।

যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন বা রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে থাকবেন তাদের হাতে এ ক্ষমতা থাকতে হবে। তবে ম্যাক্স ওয়েবার রাষ্ট্র কর্তৃত্বকে মনে করতেন একটি সূক্ষ্ম শিল্পকলার মতো।

রাষ্ট্র চালানোর জন্য শাসকের থাকতে হবে যুক্তবাদী ও গঠনমূলক চিন্তাচেতনা। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলপ্রয়োগ করার যুক্তিযুক্ত কারণ থাকতে হবে।

শাসক ও প্রশাসন পরিচালকদের আইনগত ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতে হবে। ম্যাক্স ওয়েবার শ্রেণিসংগ্রাম বা শ্রেণিসংঘাতের পরিবর্তে অভিভাবকসুলভ নেতৃত্ব ও সম্মোহনী নেতৃত্বের গুরুত্বকেই রাষ্ট্র গঠনের মূল শক্তি বলে চিহ্নিত করেছেন ।

বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলপ্রয়োগ মতবাদের পক্ষে জোরালো যুক্তি দেখালেও এর বিপক্ষে সমালোচকরা অনেক যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। সমালোচকদের দৃষ্টিতে বলপ্রয়োগ মতবাদ কী, সে সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-

রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে বলপ্রয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। রাষ্ট্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে রক্তের সম্পর্ক, ধর্ম, অর্থনৈতিক উপাদান এবং রাজনৈতিক চেতনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং রাষ্ট্র রক্ষার ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগই যদি একমাত্র উপাদান হতো তবে শক্তিশালী রাষ্ট্রের পাশাপাশি কম শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো টিকে থাকা সম্ভব হতো না।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের সম্মতি ও সমর্থনই সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি। রাষ্ট্রে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা বা রাষ্ট্র টিকে থাকার জন্য শক্তিই একমাত্র উপাদান নয়। তাই বলা হয়ে থাকে “শক্তি নয়, ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি।”

বলপ্রয়োগ মতবাদ মানবীয় গুণাবলি অস্বীকার করে। মানব চরিত্রের যে অনেক ভালো গুণ থাকতে পারে এ মতবাদে
সেগুলো উপেক্ষিত হয়েছে।

বলপ্রয়োগ মতবাদ মানবতাবিরোধী। এ মতবাদে শুধু মানবজাতির খারাপ দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে কিন্তু মানবজাতির উদারতা ও মহত্ত্ব সম্পর্কে নীরবতা পালন করা হয়েছে।

রাষ্ট্রের জন্মের মূলে শক্তি প্রয়োগ যদি একমাত্র উপাদান হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শক্তি প্রয়োগের মানসিকতা জন্মলাভ করতে পারে।

ফলে রাষ্ট্রীয় সংহতি ও ঐক্য বিনষ্ট হতে পারে ।
এ মতবাদে দেখা যাচ্ছে যে, শাসক শক্তির সাহায্যে যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন যাকে স্বৈরতন্ত্র বলা হয়। সুতরাং এ মতবাদ স্বৈরতন্ত্রের সমর্থক।

শক্তি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখে এবং বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে- একথা সর্বজন স্বীকৃত। তবে চিরদিন যে শক্তিই রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখবে— একথা সর্বজন স্বীকৃত নয় ।

· এ মতবাদ যুদ্ধ সমর্থন করে। যুদ্ধই যতসব অশান্তির কারণ। এ মতবাদ শান্তিবিরোধী ।

বলপ্রয়োগ মতবাদের সমালোচনা করলেও এর গুরুত্ব সমাজবিজ্ঞানে বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অস্বীকার করা যায় না। কারণ শক্তি ছাড়া রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। তা যদি হতো তবে রাষ্ট্র সশস্ত্র বাহিনী গঠন ও সংরক্ষণ করত না।

তাছাড়া শক্তিশালী রাষ্ট্রের পাশাপাশি দুর্বল রাষ্ট্র টিকে থাকলেও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর নতজানু পররাষ্ট্র নীতি অবলম্বনে উদাহরণের অভাব নেই।

অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য কিছু না কিছু শক্তির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

প্রাচীনকালে, মধ্যযুগে ও আধুনিক যুগে শক্তি প্রয়োগ মতবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয়ে, রাজায় রাজায় লড়াই ও রাজ্যবিস্তারের কাহিনিতে ইতিহাসের পাতা ভরপুর।

মধ্যযুগেও ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিবলে রাজ্যবিস্তার ঘটেছে। শক্তির ভিত্তিতেই রোম সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটেছে।

হক্‌স ও ম্যাকিয়েভেলি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শক্তিশালী শাসকের কথা বলেছেন। এ মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে মুসোলিনি ও হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজিয়েছেন।