প্রশ্ন : ১। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে টীকা লিখ ।অথবা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে লিখ ।

উত্তর : ভূমিকা : পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ১৯৬৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সমগ্র পাকিস্তানে জেনারেল আইয়ুব খানের একনায়কতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ববাংলার উপর জাতিগত নিপীড়ন, স্বৈরাচার, অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ স্থাপন ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এর পরের বিস্ফোরণ ছিল ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শাসক দল মুসলিম লীগের ভরাডুবির মাধ্যমে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল সব ধরনের গণতান্ত্রিক চেতনা ও আন্দোলনের ইতিহাসে নজিরবিহীন সংগ্রাম ।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান : ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে আইয়ুব খান পূর্ববাংলায় একনায়কত্ব ও অঞ্চলগত শোষণ চালান। পশ্চিমাঞ্চলের ২২টি পরিবার শোষণের প্রতীকে পরিণত হয়। পূর্ববাংলার জনগণ এসবের বিরুদ্ধে একটানা আন্দোলন-সংগ্রাম করে অকাতরে আত্মাহুতি দিচ্ছিল। ১৯ শতকীয় কায়দায় শোষণ-শাসনের পরও ১৯৬৮ সালের আইয়ুব সরকার ‘ডিউক অব রিফর্মস’ নামে ক্ষমতা দখলের এক শতক পূর্তি পালনের প্রয়াস পান। পূর্ববাংলার জনমনে এর প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক।

তারা প্রচণ্ড রোষে ফেটে পড়ে। এভাবেই প্রকৃতপক্ষে ১৯৬৮-৬৯ এর বৈপ্লবিক গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। ১৯৬৮-তে আন্দোলন শুরু করেছিল পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ (SAC) তাদের ১১ দফা কর্মসূচির ভিতর দিয়ে। পরে গণতান্ত্রিক দলগুলো SAC গঠন করে ৮ দফার মাধ্যমে আন্দোলনে নামে।

DAC-এর ৮ দফা ও SAC-এর ১ দফা কর্মসূচি সর্বস্তরের মানুষের স্বার্থ ছিল বিধায় অতি দ্রুত কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতার অংশগ্রহণের ভিতর দিয়ে আন্দোলন পূর্ণতা লাভ করে এবং নেতৃত্ব চলে যায় কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতার হাতে।

নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন এভাবে চলে যায় অনিয়মতান্ত্রিক পথে । সমগ্র দেশ জুড়ে শহরে-গ্রামে, শিল্পাঞ্চলে, অফিস-আদালতে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে শুরু হয় ঘেরাও হরতাল ।

আন্দোলন দমন করার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় হঠাৎ করে সান্ধ্য আইন তুলে নেওয়া হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি এক ঐতিহাসিক মশাল মিছিল বের হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি জনরোষের মুখে বাধ্য হয়ে আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উঠিয়ে নেয় এবং শেখ মুজিবসহ প্রায় সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দেয়।

অতঃপর ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে প্রেসিডেন্ট সর্বদলীয় নেতাদের নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন এবং অচলাবস্থা দূর করার পথ খুঁজতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি আইয়ুবের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় তিনি সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পুরো সমাজের ও জণগণের চেতনায় নজিরবিহীন প্রভাব বিস্তার করে প্রচণ্ড ছাপ রেখে যায় ৷