পাঠ-৭.৮ গণতন্ত্রের সফলতার শর্তসমূহ কি কি?

পাঠ-৭.৮ গণতন্ত্রের সফলতার শর্তসমূহ
Conditions for Success of Democracy

গণতন্ত্রের সপক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন ধরনের উক্তি, মন্তব্য প্রচারিত হলেও গণতন্ত্র বর্তমান বিশ্বে জনপ্রিয় ও উত্তম শাসনব্যবস্থা।

গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নাই। অনেক রাষ্ট্রেই গণতন্ত্রকে সাফল্যজনকভাবে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, আবার কোথাও কোথাও সফল হয়েছে।

বিভিন্ন রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সাফল্য ও ব্যর্থতার কারণ হিসেবে রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ নানা ধরনের উপাদানের কথা উল্লেখ করলেও বাস্তবক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য কতকগুলো শর্ত পূরণের প্রয়োজন ।

নিচে শর্তগুলো আলোচনা করা হলো-

১। গণতন্ত্রমনা জনগণ : গণতন্ত্রকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে সর্বাগ্রে যে বিষয়টি প্রয়োজন তা হলো জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক ধারণার উপস্থিতি।

গণতান্ত্রিক চেতনাই জনগণকে শাসনকার্যে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে। আবার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তার সাফল্যের জন্য নাগরিকদের কাছে বিশেষ যোগ্যতাও দাবি করে।

২। শিক্ষিত জনগণ : গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে ব্যাপক শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে। শিক্ষার ব্যাপক বিস্তারকে গণতন্ত্রের সাফল্যের মূলমন্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়।

গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের শাসন। আর জনগণের অধিকাংশ যদি অশিক্ষিত হয় তবে তাদের পক্ষে যোগ্য ও বিজ্ঞ প্রতিনিধি নির্বাচন করা সম্ভব হয় না।

ফলে অজ্ঞ ও অযোগ্য ব্যক্তির হাতে পড়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাই গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য জনগণের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার প্রয়োজন।

৩। যোগ্য নেতৃত্ব : যোগ্য নেতৃত্ব গণতন্ত্রের সফলতার অন্যতম প্রধান শর্ত। রাজনৈতিক নেতৃবর্গের ন্যায়নীতি।

বিবেকবোধের উপর গণতন্ত্রের সাফল্য বহুলাংশে নির্ভরশীল। স্বার্থপর ও স্বেচ্ছাচারী নেতৃত্ব গণতন্ত্রের কবর রচনা করে।

এছাড়া দুর্বল নেতৃত্বের কারণে বহু দেশে আজ গণতন্ত্র বিপদের সম্মুখীন। এ কারণে রাষ্ট্রনেতাগণের ন্যায়পরায়ণতা, সততা, উদারচিত্ত, বিবেকবোধ প্রভৃতি গুণ গণতন্ত্রের সাফল্যের প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে গণ্য হয় ।

৪। একাধিক রাজনৈতিক দল : গণতন্ত্রের সাফল্যে একাধিক রাজনৈতিক দল ও বিরোধী দলের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

একাধিক রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চলতে পারে না। এছাড়া একটি শক্তিশালী ও সুসংহত বিরোধী দল থাকলে সরকার সব সময় সতর্ক থাকে, জনস্বার্থসাধনে আত্মনিয়োগ করতে বাধ্য হয়। এবং স্বৈরাচারী হতে পারে না।

৫। জনমত : কেবল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেই গণতন্ত্র টিকে থাকবে না।

একে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন সুস্থ, সবল ও সদা জাগ্রত জনমত। সদা সতর্ক এবং সক্রিয় জনমত সরকারের স্বৈরাচারিতা রোধ করে এবং সরকারকে গণমুখী করে।

তাই গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য সুস্থ, সবল ও সদা জাগ্রত জনমত অপরিহার্য।

৬। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা।
আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও ব্যাখ্যার জন্য বিচার বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।

বিচারকগণ যেন সব ধরনের ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পালন করতে পারেন তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

এজন্য বিচার বিভাগকে আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে।

৭। সহনশীলতা : সহনশীলতা বা পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের প্রাণ। গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন।

তাই এ শাসনব্যবস্থাকে সফল করতে হলে সংখ্যালঘিষ্ঠরা যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন মেনে নেবে, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠকেও সংখ্যালঘু তথা বিরোধী দলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল মনোভাব পোষণ করতে হবে।

সহনশীল মনোভাব না থাকলে গণতন্ত্র সফল হতে পারে না ।

৮। আইনের শাসন : গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো আইনের শাসনের উপস্থিতি।

আইনের শাসন নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতার রক্ষক এবং শাসকের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার উপায়। আইনের চোখে সবাইকে সমানভাবে দেখতে হবে।

এতে সবাই সমান অধিকার ভোগ করতে পারবে এবং গণতন্ত্র সফল হবে।

৯। লিখিত সংবিধান : গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য লিখিত সংবিধান কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

লেকি, হেনরি মেইন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতানুসারে, সংবিধান লিখিত হলে জনসাধারণ সরকারের বিভিন্ন কার্য ও কর্তৃত্বের পরিধি এবং নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত থাকতে পারে।

ফলে জনগণ যেমন তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকে, তেমনি সরকারের কার্যাবলির উপর সতর্ক থাকে।

যে কারণে সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না। তাই গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য লিখিত সংবিধানের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

১০। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি : জাতীয় ঐক্য ও সংহতির উপর গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে।

মিলের মতানুসারে,
জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন গণতন্ত্র বিকাশের পক্ষে সহায়ক। জনগণের মধ্যে যদি জাতীয় ও সামাজিক ঐক্যবোধ না থাকে তাহলে গণতন্ত্র সফল হতে পারে না।

জাতীয় ঐক্য ও সংহতি অর্জনের স্বার্থে জাতিভেদ প্রথা ও অন্যান্য সামাজিক বৈষম্য দূর করা উচিত।

১১। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা : গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে ব্যক্তি অধিকার ও স্বাধীনতা সংরক্ষণ প্রয়োজন।

স্বাধীন বিচার বিভাগই ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকারের রক্ষক হিসেবে ভূমিকা রাখে। সরকারের স্বেচ্ছাচারী আচরণ থেকে ব্যক্তিকে মুক্ত রাখতে হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকতে হবে।

গণতন্ত্রের সফলতায় এটা অপরিহার্য। অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski) বলেন, “The independence of the Judiciary is essential for freedom and democracy.”

১২। উন্নত নৈতিকতা : সরকারব্যবস্থায় যদি অসৎ প্রবণতা, কালোবাজারি, চোরাচালানসহ অনৈতিক কার্যকলাপ নির্বিঘ্নে সংঘটিত হয় তাহলে সেখানে গণতন্ত্র সফল হবে না।

কাজেই গণতন্ত্রের সফলতার জন্য জনগণসহ দেশের সর্বস্তরের নাগরিককে দেশপ্রেমিক, আত্মনিয়ন্ত্রণকারী, সৎ, শৃঙ্খলারক্ষাকারী প্রভৃতি উন্নত নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন হতে হবে।

১৩। দেশপ্রেম : গণতন্ত্রের সফলতার জন্য সরকার, বিরোধী দল ও সর্বস্তরের নাগরিকের দেশপ্রেম প্রয়োজন ।

দেশপ্রেম থাকলে সব বিরোধ ও সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। দেশপ্রেম গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখে এবং জাতিকে উন্নতির দিকে পরিচালিত করে সামাজিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দের ভিত মজবুত করে।