প্রশ্ন ॥১.১৫ একজন আর্থিক ব্যবস্থাপকের তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য কি কি সিদ্ধান্ত [জা.বি. ২০০৫, ২০০৯, ২০১৪ (পুরাতন)]অথবা, একজন আর্থিক ব্যবস্থাপকের মূল লক্ষ্যসমূহ কি কি?অথবা, কি কি লক্ষ্য নিয়ে একজন আর্থিক ব্যবস্থাপক কাজ করে?অথবা, আর্থিক ব্যবস্থাপকের প্রতিষ্ঠানের জন্য কোন কোন ধরনের লক্ষ্য থাকা উচিত?

উত্তর : ভূমিকা : “লক্ষ্যহীন জীবন, মাঝিহীন নৌকার মতো।” উদ্দেশ্যহীনভাবে কোন কাজ করলে আদৌ সে কাজ থেকে প্রত্যাশিত ফল আসে না, বরং উল্টো ঘটনা ঘটে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকতে হবে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

→ আর্থিক ব্যবস্থাপকের লক্ষ্যসমূহ : প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য অর্জন যার উপর নির্ভর করে এবং মূল লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে ব্যক্তি সকল প্রকার সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে সঠিকভাবে গ্রহণ করে থাকেন তাকেই আর্থিক ব্যবস্থাপক বলে। একটি প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আর্থিক ব্যবস্থাপনা মূলত দুটি উদ্দেশ্যকে আশ্রয় করে কাজ করেন। যদিও আরও অনেক আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য থাকে। নিম্নে একজন আর্থিক ব্যবস্থাপকের প্রধান প্রধান উদ্দেশ্যগুলো বর্ণনা করা হলো :

১. মুনাফা সর্বোচ্চকরণ : একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপকের প্রথম উদ্দেশ্য থাকে সর্বোচ্চ মুনাফার্জন করা। কারণ আর্থিক ব্যবস্থাপককে সর্বোচ্চ মুনাফার ব্যাপারে সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ে অর্থ বিনিয়োগ করে ব্যবসায় হতে মালিকের প্রাপ্তিই হচ্ছে মুনাফা। অর্থাৎ‍ প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে ভোক্তার সন্তুষ্টি বিধানের মাধ্যমে সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করাই আর্থিক ব্যবস্থাপকের মূল উদ্দেশ্য।

২. সম্পদ সর্বোচ্চকরণ : ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মুনাফা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দিলেও এর অনেক সীমাবদ্ধতা এবং ত্রুটির কারণে বর্তমানে আর্থিক ব্যবস্থাপকের তথা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ সর্বোচ্চকরণই প্রধান এবং যুগোপযোগী উদ্দেশ্য। মুনাফার চেয়ে সম্পদই বেশি স্থায়ী। তাই সম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক প্রত্যাশা পূরণ সহজ এবং শ্রেয়। সম্পদ বৃদ্ধির মধ্যেই সম্পূর্ণ কল্যাণ নিহিত।

৩. প্রতিষ্ঠানের তারল্য বৃদ্ধি : আর্থিক ব্যবস্থাপকের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের তারল্য বৃদ্ধি করা। প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কর্মকাণ্ড নির্বাহ করার জন্য প্রচুর নগদ অর্থের প্রয়োজন হয় এবং আর্থিক ব্যবস্থাপক সে উদ্দেশ্যেই কাজ করেন ।

৪. মূলধন সংরক্ষণ : ব্যবসায়ে বিনিয়োগকৃত অর্থ বিভিন্ন রকম ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার হাত থেকে রক্ষা করা আর্থিক ব্যবস্থাপকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। কারণ দক্ষ বিনিয়োগের পাশাপাশি উক্ত অর্থের সদ্ব্যবহার এবং সংরক্ষণ করা আর্থিক ব্যবস্থাপকের জন্য আবশ্যকীয় ।

৫. কাম্য মূলধন কাঠামো গঠন : প্রতিষ্ঠানের কাম্য মূলধন গঠন অর্থাৎ কি পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করা হবে এবং কি পরিমাণ মালিকি মূলধন হবে তা নির্ধারণ করা আর্থিক ব্যবস্থাপকের বিশেষ উদ্দেশ্য।

৬. ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা পরিহার : অলাভজনক প্রকল্পসমূহ পরিহার করে শুধুমাত্র লাভজনক খাতে অর্থ বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অর্জন করা এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ঝুঁকি ও বিনিয়োগের মধ্যে সমন্বয়সাধন করা আর্থিক ব্যবস্থাপকের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে অভিহিত।

৭. প্রতিযোগিতা মোকাবিলা : যে কোন ধরনের জটিল পরিস্থিতি সহজে মোকাবিলা করার মত প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সচ্ছলতা অর্জন করা এবং যে কোন ধরনের দুরবস্থা প্রতিরোধ করা আর্থিক ব্যবস্থাপকের মুখ্য উদ্দেশ্য।

৮. প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা : প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং উক্ত প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে দিন দিন প্রবৃদ্ধির হার আরও বৃদ্ধি করে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করা আর্থিক ব্যবস্থাপকের অন্যতম উদ্দেশ্য।

৯. জীবনযাত্রার মনোন্নয়ন : ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান যখন অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তখন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনভাতাদি বৃদ্ধি পায় এবং তাদের জীবনযাত্রার মানও বৃদ্ধি পায় । আর এ উদ্দেশ্যের মূল প্রবক্তা হচ্ছে আর্থিক ব্যবস্থাপক। অর্থাৎ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা আর্থিক ব্যবস্থাপকের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।

১০. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : ব্যষ্টিক উন্নয়নের পথ ধরে আসে সামষ্টিক উন্নয়ন। একটি প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেই দেশীয় অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়ে। সুতরাং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে শরিক হওয়া আর্থিক ব্যবস্থাপকের বিশেষ উদ্দেশ্য।

১১. ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতা অর্জন : বিভিন্ন প্রকার ব্যবস্থাপকীয় সিদ্ধান্ত এবং কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় এবং নানারকম প্রশিক্ষণের দ্বারা আর্থিক ব্যবস্থাপকের নিজের এবং প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য লোকবলের ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতা অর্জনে সহযোগিতা করাই মূল উদ্দেশ্য ।

১২. সুনাম ও সমৃদ্ধি অর্জন : একজন আর্থিক ব্যবস্থাপকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সকলের সুনাম ও সমৃদ্ধি অর্জন করা। কারণ প্রতিষ্ঠানের যদি সুনাম না থাকে তবে সংশ্লিষ্ট সকলেই সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয় ।

১৩. সুষম কর নীতি : প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারকে নির্দিষ্ট হারে কর প্রদান করতে হয়। সে কর প্রদানের ক্ষেত্রে একটি সুষম বা সঠিক কর নীতি প্রণয়ন করা আর্থিক ব্যবস্থাপকের প্রধান উদ্দেশ্য ।

১৪. সামাজিক কল্যাণ : একজন আর্থিক ব্যবস্থাপকের শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বা সম্পদ বৃদ্ধি করাই উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হতে ২ পারে না। পাশাপাশি তাকে সমাজ, সমাজের মানুষ এবং দেশের সার্বিক কল্যাণের কথাও ভাবতে হয়। কারণ প্রতিষ্ঠান এমন কাজ করে না বা এমন সিদ্ধান্ত নিবে না, যা দ্বারা সমাজের বা দেশের ক্ষতিসাধন হয়। সুতরাং সামাজিক কল্যাণের কথা চিন্তা করাও আর্থিক ব্যবস্থাপকের অন্যতম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

১৫. সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ স্থাপন : জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকার প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন এবং সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করাও একজন আর্থিক ব্যবস্থাপকের অন্যতম উদ্দেশ্য। কারণ বর্তমান ব্যবস্থাপনা যোগাযোগভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আর্থিক ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানের বা ব্যবসায়ের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বহুমুখী উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। তবে একটি প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য বলতে মুনাফা বৃদ্ধি করা এবং সম্পদ বৃদ্ধি করাকেই বুঝানো হয়। যদিও অন্যান্য আরও অনেক প্রধান প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য সংরক্ষণ স্থির করতে হয়। অন্যথায় প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।