প্রশ্ন : ৮.১। ১৯৭০ সালের নির্বাচন সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখ ।অথবা, ১৯৭০ সালের নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা কর।

১৯৭০ সালের নির্বাচন সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ :

উত্তর : ভূমিকা : দেশে একটি শাসনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের অঙ্গীকার নিয়ে সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন।

এ নির্বাচনই পাকিস্তানি রাজনীতির ২৪ বছরের ইতিহাসে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভৌটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচন। উক্ত নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপিপি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে।

এ নির্বাচনের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা, ভুট্টো-ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বাংলাদেশের আবির্ভাবকে সহজতর করে।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পটভূমি : ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতাচ্যুত হলে ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া খান। তিনি সামরিক আইন জারি করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই তিনি ১৯৬২ সালের সংবিধান, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ বাতিলসহ সকল প্রকার রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

তবে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে ইয়াহিয়া খান জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধির নিকট ক্ষমতা অর্পণের অঙ্গীকার করেন। এ অঙ্গীকার অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদ এবং ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়।

তবে সময়মতো নির্বাচন না হওয়ায় জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ৭ ডিসেম্বর এবং প্রাদেশিক পরিষদের ১৯ ডিসেম্বর পুনঃনির্ধারিত হয়। কিন্তু ১২ নভেম্বর পূর্ববাংলায় এক প্রলঙ্ককরী ঘূর্ণিঝড়ে আঘাত হানলে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন : নিম্নে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ইয়াহিয়ার আইনগত কাঠামো আদেশ : ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কতিপয় শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপসহ আইনগত কাঠামো আদেশ জারি করে। আইনগত কাঠামো আদেশের বিধানসমূহ নিম্নরূপ :
(ক) সাধারণ নির্বাচন সংক্রান্ত বিধান ।
(খ) জাতীয় পরিষদ সংক্রান্ত বিধান ।
(গ) সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত বিধান ।

এ আইনগত কাঠামোগত প্রেসিডেন্টের হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত থাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এ আদেশের তীব্র সমালোচনা করা হয়।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলসমূহ : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যেসব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে সেগুলো হচ্ছে—
১. আওয়ামী লীগ,
২. পাকিস্তান পিপলস পার্টি,
৩. ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি,
৪. মুসলিম লীগের বিভিন্ন গ্রুপ,
৫. জামায়াতে ইসলামী,
৬. জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম,
৭. জমিয়তে উলামা-ই-পাকিস্তান,
৮. নেজামে ইসলাম এবং
৯. পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি।
নির্বাচনি ইস্যু : এ নির্বাচনে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির নির্বাচনি ইস্যু ছিল পৃথক পৃথক। যেমন-

১. বাঙালির ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ঐক্যবোধ গড়ে উঠে সময়ের গতিধারায় ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন এবং ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তার শাণিত ধারা লক্ষ করা যায়। আর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের ফলে বাঙালি ও বাংলার মানুষের ঐক্য ও সংহতি যে সুদৃঢ় তা প্রকাশ পায়। প্রকৃতপক্ষে এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাঙালির ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

২. পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও এ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। নির্বাচনের ইশতিহার ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শেখ মুজিবুর রহমানের দেশব্যাপী জনসংযোগ সর্বস্তরের পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮ আসন লাভ করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের বিপুল জনপ্রিয়তা প্রকাশ পায়। আওয়ামী লীগের এ নিরঙ্কুশ বিজয় ও জনপ্রিয়তা বহির্বিশ্বেও নন্দিত হয় ।

৩. পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত করা হয়েছিল। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বসবাস এ অঞ্চলে হলেও তাদের ন্যায়সংগত দাবি পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি দীর্ঘদিন যাবৎ অবজ্ঞা করা হয়। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে উভয় পরিষদে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সম্ভাবনা দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের দেওয়া এ ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে জনগণ অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহের কর্মসূচিকে প্রত্যাখ্যান করে। পাকিস্তানে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে- ডানপন্থি দলসমূহের এ চিরাচরিত ভাওতাবাজিকে পূর্ববাংলার জনগণ প্রত্যাখ্যান করে ।

৪. জাতীয় ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি : সংগঠনের দিক থেকে আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)-উভয়ই ছিল আঞ্চলিক। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা সকলেই পূর্ব পাকিস্তানি এবং পিপিপি-এর সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানি পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রায় সবগুলো আসন লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানে তারা কোনো আসন পায় নি। পক্ষান্তরে জুলফিকার আলীর পিপিপি পূর্ব পাকিস্তানে কোনো প্রার্থী মনোনয়ন দিতে না পারলেও পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৮ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে এ নির্বাচনের রায় এটাই প্রমাণ করে যে, পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক দলই জাতীয়ভিত্তিক রাজনৈতিক দল নয়।

৫. আঞ্চলিক দলের স্বীকৃতি : ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রায় স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টিকে আঞ্চলিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। দুটি দলই নিজেদের অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বের অধিকার লাভ করে।

৬. পশ্চিম পাকিস্তানের একক কর্তৃত্বের অবসান বার্তা : একক কর্তৃত্বের অবসান বার্তা : এ নির্বাচন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একক কর্তৃত্বের অবসান বার্তাস্বরূপ। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় আওয়ামী লীগ ও বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের ন্যায্য সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। এর ফলে এতদিনের পশ্চিমা কর্তৃত্বের অবসান সূচিত হয়।

৭. পাকিস্তানের জাতীয় সত্তা রক্ষার চ্যালেঞ্জ উপস্থিত : দুই প্রদেশে দুটি দল প্রাধান্য লাভ করায় পাকিস্তানের নির্বাচনোত্তর অবস্থা অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে। জাতীয় প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে কোন দল বৈধ এ প্রশ্ন সমস্যা আকারে দেখা দেয়। আর এ কারণেই এ নির্বাচন পাকিস্তানের জাতীয় সত্তা রক্ষার জন্য এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত হয়। অবশ্য পাকিস্তানের তদানীন্তন গদিনসীন সরকার এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিলে পাকিস্তানের জাতীয় সত্তা দ্বিখণ্ডিত হয়।

৮. রাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি : নির্বাচনী রায় মোতাবেক ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে রাজনৈতিক সংঘাত অত্যাসন্ন হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সংঘাত সামরিক সংঘাতে পরিণত হয়।

৯. বাঙালির সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত : নির্বাচনী রায় মোতাবেক ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতিকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। তারা আরো আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়, যা তাদেরকে মুক্তি সংগ্রামে নিবেদিত করে।

১০. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বার্তাবাহক : সর্বোপরি ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বার্তাবাহক। এই নির্বাচনী রায় মোতাবেক যে রাজনৈতিক সংঘাত ও জটিলতা সৃষ্টি হয় তার পথ ধরেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের মধ্যে যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে উঠে তা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবোধের এক অভূতপূর্ব বহিঃপ্রকাশ। দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার এক মূর্ত সম্ভাবনা।

কিন্তু পাকিস্তানি শাসকচক্র ও পিপিপি নেতা ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের ফলে নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা, ২৫ মার্চের গণহত্যা এবং স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধ শুরু হয়। যার শেষ অধ্যায় ছিল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তাই এ নির্বাচন যেমন ছিল গুরুত্বপূর্ণ তেমনি নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করেছিল ।

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related