বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা
উত্তর : ভূমিকা : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের মাধ্যমেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ ভাষণের মাধ্যমেই বাঙালি জাতি মানসিকভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, যা তাদেরকে স্বাধীন বাংলা ও শত্রুমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রয়াস জাগিয়েছিল। বাঙালি জাতির এই একাগ্রতা আর স্বাধীনতার ঘোষণা এসেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকেই ।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা : বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে তিনি স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেন। তার ভাষণের সুস্পষ্ট যে দিকগুলো রয়েছে সে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি : বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা প্রত্যাশী বাঙালির নিকট অসহযোগ আন্দোলনকে সুপরিচিত করেন ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে। তিনি তার ভাষণের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের কোনোরূপ সাহায্য ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান অচল হয়ে যাবে। আর এ কথার প্রমাণ মেলে তার ভাষণের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তবে তোমরা সবকিছু বন্ধ করে দেবে” আর এভাবে তিনি বাঙালি জাতির মধ্যে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ স্পৃহা সৃষ্টি করেছিলেন।
২. সমগ্র দেশে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে সুস্পষ্ট স্বাধীনতার ঘোষণা এনেছে। কেননা তিনি বলেন, “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো”। এ উক্তির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সমগ্র দেশব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বাঙালিদেরকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, প্রতিরোধ ছাড়া বাঙালি কোনো দিনও তার ন্যায্য অধিকার পাবে না। আর সেই সাথে কখনই স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় নিজেদেরকে উপস্থাপন
করতে পারবে না ।
৩. মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সুস্পষ্ট স্বাধীনতার ঘোষণা। কেননা এই ভাষণেই তিনি সবাইকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, “তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে।” এ উক্তির মাধ্যমে তিনি যুদ্ধের ইঙ্গিত প্রদান করেন। তিনি তার ভাষণে আরো বলেন, “আমরা অনেক রক্ত দিয়েছি। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।” তার এই প্রেরণামূলক বাণীই পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল ।
৪. স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতিহার : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো তার ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহারের পথ সুগম হয়। কেননা ২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে পূর্ববাংলার সর্বত্রই পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়, যা ৭ মার্চের ভাষণের ফলাফল ৷
৫. বাঙালির মনোবল জাগ্রত : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালির মনোবল জাগ্রতের কথা বলা হয়েছে। এখানে তিনি বলেন, “তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে, রাস্তাঘাট, যা যা আছে সবকিছু— আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দিবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো।” বঙ্গবন্ধুর এই জ্বালাময়ী জাগ্রত বাণী বাঙালির মনোবলকে আরো বেশি জাগ্রত করেছিল।
৬. শত্রুর মোকাবেলায় গেরিলা কৌশল : ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতার ঘোষণাই দেন নি; বরং তিনি বাঙালি জাতির প্রতিরোধ আন্দোলনকে স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপ দিতে বলেছেন। তিনি বাঙালিকে তার ভাষণের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বনের নির্দেশ দেন। কারণ তিনি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সংগ্রামে জয়ী হতে গেলে বাঙালিকে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে ।
৭. সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় রাখা : ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় রাখতে বলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ইসলামের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানিরা এদেশের মুসলমান জনগণকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করবে এবং নানা প্রকার উস্কানিমূলক বাক্য উচ্চারণ করে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও একতা নষ্ট করবে। তাই বাঙালিদের মধ্যে যেন এ ঐক্য নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে সকল প্রকার উস্কানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার নির্দেশ দেন।
৮. সুদৃঢ় নেতৃত্ব : বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে একটি সুপরিকল্পিত ও সুন্দর নেতৃত্ব দান করেন। হতাশাগ্রস্ত বাঙালিকে সুসংঘবদ্ধ করে তাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করেন তিনি। তার এ পথ প্রদর্শন ও সুকৌশলী নেতৃত্বের জন্য তাকে বাঙালি জাতির পিতা বলা হয় ।
৯. স্বাধীনতা ঘোষণা : ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলেও মূলত স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়াউর রহমান বীর উত্তম বলেন, “I am Major Zia on behalf of our national leader Bangabandhu Shekh Muzibur Rahman declare the independence of Bangladesh.” এই উক্তির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন জিয়া সে কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। সুতরাং বলা যায় চূড়ান্ত স্বাধীনতা ঘোষণা হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চেই। ২৬ মার্চ তার পুনরাবৃত্তি হয়েছে মাত্র। এ স্বাধীনতার ডাকেই বাংলার মানুষ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে । কেননা তার এই ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতি বুঝতে পেরেছিল যে আসলে তাদেরকে কি করতে হবে। তিনি বাঙালি জাতিকে সকল অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত করে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বাঙালি জাতিকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন এবং শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য নির্দেশ দেন। তাই একথা বলতে পারি যে, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বাংলার যে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছেন এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। মূলত ৭ মার্চের ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় । আর অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।