পাঠ-৪.২ : সুশাসন ও ই-গভর্ন্যান্স
Good Governance & E-Governance:
শাসনব্যবস্থায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শাসনব্যবস্থাকে গতিশীল, দক্ষ অংশগ্রহণমূলক করা হয়েছে, বরে ইলেকট্রনিক গভর্ন্যান্স বা ই-গভর্ন্যান্স বলা হয়।
শাসনক্ষেত্রে এটি একটি নতুন ধারণা, যা বাস্তবায়নের প্রধান মাধ্যম হলে তথ্য ও প্রযুক্তি। ই-গভর্ন্যান্স হলো উন্নয়নের চাবিকাঠি।
এর চূড়ান্ত লক্ষ্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। অন্যভাবে বলা যায়, আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে দক্ষ ও কার্যকরভাবে ব্যবহার করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই হলো ই-গভর্ন সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনাই সুশাসন।
সুশাস অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা, দক্ষ, কার্যকর ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক সরকার, জনগণে প্রয়োজন ও চাহিদার প্রতি সরকার কর্তৃক দ্রুত সাড়া প্রদান করা।
আর সুশাসনের এসব বৈশিষ্ট্য পূরণের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা হলো ই-গভর্ন্যান্স। কেননা সুশাসনের লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য ই-গভর্ন্যান্সের লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।
তাই ই-গভর্ন্যান্স প্রবর্তনের মাধ্যমে খুব সহজেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় ।
ই-গভর্ন্যান্স তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারি তথ্য ও সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়, সরকার ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনে, আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও প্রশাসনিক কাঠামোর জটিলতা দূর করে।
এতে করে নাগরিকদের সমান অধিকার ও আইনের শাসন নিশ্চিত হয় সরকারি কর্মকাণ্ডে নাগরিকদের হয়রানি ও বিড়ম্বনার অবসান ঘটে এবং দেশে সুশাসনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ ও নিষ্কণ্টক হয়।
মূলত ই-গভর্ন্যান্স সুশাসনের সহায়ক শক্তি। তবে সুশাসনে ই-গভর্ন্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এর কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে।
তাই ই-গভর্ন্যান্সের সুফল ও সুবিধা ভোগের পাশাপাশি দেশে সুশাসন কায়েম করতে এ প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ই-গভর্ন্যান্সের সুবিধা
Advantage of E-Governance:
ই-গভর্ন্যান্স আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শ শাসনব্যবস্থা।
এটি আধুনিক কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবস্থার যুগান্তকারী ফসল।
ই-গভর্ন্যান্স তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাহায্যে সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে দ্রুত ও সহজে যোগাযোগ স্থাপনে অনন্য ভূমিকা রাখে।
সরকারি সেবা প্রদান এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রে সুশাসন কায়েম করে।
ই-গভর্ন্যান্স দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যায়। বলা বাহুল্য নয় যে, পৃথিবীর যেসব দেশে ই- গভর্ন্যান্স ব্যবস্থা চালু হয়েছে সেসব দেশ তত উন্নত ও সমৃদ্ধ।
কেননা ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থায় সরকার ও রাষ্ট্রের নাগরিকরা অনেক সুবিধা পায় ।
ই-গভর্ন্যান্সের সুবিধাসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো :
১। সরকারের কার্যক্রমের জবাবদিহিতা : ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে সরকারের কার্যক্রমের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পায়।
জনগণ অনলাইনের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রস্তাবিত নীতিমালার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত জানাতে পারে। এতে সরকারের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।
২। অর্থ সাশ্রয় হয় : ই-গভর্ন্যান্স সরকার ও জনগণের সময় ও অর্থ সাশ্রয় করে। অনলাইনের মাধ্যমে কম সময়ে ও কম অর্থ ব্যয়ে নাগরিক সেবাসমূহ নিশ্চিত করা যায়।
যেমন- অনলাইনে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের বিল পরিশোধ, আয়কর রিটার্ন দাখিল ইত্যাদি। এতে যাতায়াত খরচ ও সময়ের অপচয় কম হয়।
৩। দুর্নীতি প্রতিরোধ : ই-গভর্ন্যান্স প্রক্রিয়ায় ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দুর্নীতি ও অসৎ উপায় প্রতিহত করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়।
অবাধ তথ্যপ্রাপ্তির সুবিধার কারণে সরকারি কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায় এবং দুর্নীতি হ্রাস পায়।
৪। ব্যবসায় উন্নয়ন : তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়।
বাজারে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের চাহিদা, সরবরাহ, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি বিষয়ে যাবতীয় তথ্য প্রাপ্তি মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট জনসাধারণের জন্য সহজতর করে তুলেছে।
ফলে ব্যবসায় উন্নয়নে ই-গভর্ন্যান্স বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
৫। দক্ষতা বৃদ্ধি : অটোমেশন, কম্পিউটারাইজড ও নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠে। কর্মীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা শাসনব্যবস্থাকে গতিশীল করে।
৬। নীতিনির্ধারণে সহায়তা : ই-গভর্ন্যান্স ব্যাপক ডাটাবেজ তৈরি করে, যেখানে নীতিনির্ধারকগণ সহজে নীতিনির্ধারণ ও তার যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে পারেন।
৭। দক্ষ আমলাতন্ত্র : ই-গভর্নান্স আমলাদের দক্ষ ও পারদর্শী করে তোলে। আমলারা পুরনো পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে গতিশীল ও নির্ভরযোগ্য করে তোলেন।
এতে জনদুর্ভোগ কমে এবং জনগণ সরকারি সেবা সহজে পেতে পারে।
৮। সম্পদব্যবস্থার উন্নয়ন : অবাধ তথ্যপ্রবাহের মাধ্যমে সরকার সহজেই সব বিষয়ে জানতে পারে।
রাষ্ট্রীয় সম্পদব্যবস্থার উন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণে সহায়তা করে ডিজিটাল গভর্ন্যান্স ।
৯। কর্মসংস্থান সৃষ্টি : ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটে। রাষ্ট্রের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীও তথ্যপ্রযুক্তির সেবা পেতে সক্ষম হয়।
বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থানের সুযোগপ্রাপ্তি ঘটে। এক্ষেত্রে স্বল্পশিক্ষিত বেকার যুবকরা তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ নিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ লাভ করে।
১০। আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন : আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে অপরাধী শনাক্ত করতে পারে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
১১। দারিদ্র্য দূরীকরণে : দারিদ্র্য দূরীকরণে ই-গভর্ন্যান্স বিশেষ ভূমিকা রাখে। ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে সরকার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষায় দ্রুত সাড়া প্রদান করতে পারে।
এক্ষেত্রে অধিকতর দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকায় সরকার দ্রুত ও বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করতে সক্ষম হয়। এতে দারিদ্র্য দূর হয়।
এছাড়া প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার জনগণকে দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়তা প্রদান করে থাকে।
১২। জন-অংশগ্রহণ বৃদ্ধি : ই-গভর্ন্যান্স কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি করে।
বিভিন্ন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণ ঘরে বসেই অংশগ্রহণ করতে পারে।
ঘরে বসেই অনলাইনে মতামত প্রদানের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রমে জনসম্পৃক্ততার বৃদ্ধি ঘটায় ।
১৩। গ্রামীণ উন্নয়ন : ই-গভর্ন্যান্স কর্মসূচি বাস্তবায়নে অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর প্রচেষ্টা চালানো হয়।
এতে শহরমুখী উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনেও উন্নয়নের জোয়ার আসে। তাই বলা যায়, ই-গভর্ন্যান্স গ্রামীণ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারের সেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়।
১৪। জনগণের ক্ষমতায়ন : তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়।
জনগণ রাজনৈতিক সচেতন হয়ে ওঠে। সরকার ও রাজনৈতিক আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতামত প্রদান করতে পারে।
রাজনৈতিক উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় জন-অংশগ্রহণ জনগণের ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করে।