সামাজিক বনায়ন (Social Forestation)
(জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, “সামাজিক বনায়ন হলো এমন বন ব্যবস্থাপনা বা কর্মকাণ্ড যার সাথে পল্লির দরিদ্র জনগোষ্ঠী ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এর মাধ্যমে উপকারভোগী জনগণ কাঠ ও জ্বালানি, খাদ্য, পশুখাদ্য ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পেয়ে থাকে।”
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, “সামাজিক বনায়ন হলো গ্রামীণ জনগণের প্রয়োজনে বনায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং আহরণ পর্যন্ত সকল কাজে তাদের সম্পৃক্তকরণ এবং তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতকরণ।”
সুতরাং সহজভাবে বলা যায়, সামাজিক বনায়ন হলো জনসাধারণ বিশেষ করে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী গ্রামীণ জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বাস্তুসংস্থানিক সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে পরিচালিত বনায়ন ।
বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম
ষাটের দশকে এ দেশে সামাজিক বনায়নের গোড়াপত্তন ঘটে।
জনগণকে বনায়নে উৎসাহিত করার জন্য বন বিভাগ (১৯৬০ সালে বন সম্প্রসারণ কার্যক্রম শুরু করে। এ কর্মসূচির আওতায় ১৯৬৩ সালে সর্বপ্রথম কুমিল্লায় বন সম্প্রসারণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৯৭৯ সালে চট্টগ্রামের বেতাগীতে ৪০০ একর পাহাড়ি খাস জমিতে স্থানীয় ভূমিহীনদের নিয়ে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম শুরু হয়।
বন বিভাগ ১৯৮২ সাল হতে স্থানীয় দরিদ্র জনগণকে উপকারভোগী নিয়োগ করে অংশীদারিত্বমূলক সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম শুরু করে।
সরকারি পর্যায়ে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৭টি বৃহত্তর জেলা দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও যশোর জেলায় ১৯৮২ সাল হতে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত কমিউনিটি ফরেস্ট্রি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
২০০০ সালে ১৯২৭ সালের বন আইন সংশোধনপূর্বক ২৮(ক) ধারা সংযোজন করে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমকে বন আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
এ ছাড়াও সামাজিক বনায়ন বিধিমালা ২০০৪ তৈরি করা হয়েছে। সামাজিক বনায়ন বিধিমালাকে আরো যুগোপযোগী করার জন্য এর বিভিন্ন ধারা সংশোধন ও কিছু নতুন ধারা সংযোজন করে ১৩ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে প্রজ্ঞাপন আকারে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
সামাজিক বনায়নের গুরুত্ব (Importance of Social Forestation):
১. শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ :
কাঠনির্ভর শিল্প যেমন-কাগজকল, নিউজপ্রিন্ট মিল, পাল্পউড মিল, হার্ডবোর্ড মিল, পার্টিকেল বোর্ড মিল, প্লাইউড, রাবার ফ্যাক্টরি, ফার্নিচার ফ্যাক্টরি, করাত কল প্রভৃতির কাঁচামাল সরবরাহ ও কুটির শিল্পের কাঁচামাল বাঁশ, বেত ও মূর্তা সরবরাহ বনায়নের ভূমিকা অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ।
২.জ্বালানি সরবরাহ :
বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮.০ মিলিয়ন ঘনমিটারের বেশি জ্বালানি কাঠের চাহিদা রয়েছে।
প্রাকৃতিক বন কমে যাওয়ায় বর্তমানে জ্বালানি ও কাঠের মোট সরবরাহের প্রায় ৮২-৯৯% আসে গ্রামীণ বন তথা সামাজিক বন হতে।
.
৩. ওষুধ শিল্পে :
বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে হাজার রকমের ওষুধি গাছগাছড়া।
এক রিপোর্টে দেখা যায়, এ দেশে প্রায় ৪৪টি বনৌষধি কোম্পানি রয়েছে, যাদের বার্ষিক বিক্রয় ১০ লক্ষ থেকে ৬ কোটি টাকা পর্যন্ত । ওষুধি গাছ সংগ্ৰহ থেকে প্রক্রিয়াকরণ বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৪. নার্সারি ব্যবসায় :
বাংলাদেশে বন বিভাগের আওতাধীনে প্রতিটি উপজেলায় সরকারি নার্সারি ছাড়াও এনজিও এবং ব্যক্তিমালিকানায় সারাদেশে রয়েছে অসংখ্য নার্সারি। নার্সারি ব্যবসা করে অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
৫. আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে :
পরিবেশগত উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে।
পরিত্যক্ত এবং অনুপযোগী পতিত জমি, সড়কের ও রেল লাইনের ধারে, পুকুর পাড় প্রভৃতিতে সামাজিক বন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করেছে।
সামাজিক বনায়নের প্রকারভেদ (Kinds of Social Forestation):
সামাজিক বন বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন-
১. বসতবন :
বসতবাড়ি ও এর আশেপাশে স্বল্প পরিসরে প্রধানত পারিবারিক প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানোর ব্যবস্থাকে বসতবাড়ি বনায়ন বলে।
এ বনের গাছপালা হলো আম, কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারি ইত্যাদি ।
২. কৃষিবন :
আন্তর্জাতিক কৃষি বনায়ন গবেষণা কেন্দ্র (ICRAF, 1995)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী “কৃষি বনায়ন হচ্ছে এমন একটি ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যার মাধ্যমে একই ভূমিতে বৃক্ষ, ফসল, পশু ও পশুখাদ্য উৎপাদন করা হয়, যাতে একে অন্যের উৎপাদনকে ব্যাহত না করে, পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়।”
যশোর, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর জেলার আবাদি জমির মধ্যে খেজুর, তাল, বাবলা ইত্যাদি গাছ কৃষিবনের জ্বলন্ত উদাহরণ।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক বন :
অফিস-আদালত, শিক্ষা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ প্রভৃতিতে গাছ লাগিয়ে যে বনায়ন সৃষ্টি করা হয় তা হলো প্রাতিষ্ঠানিক বন।
কৃষ্ণচূড়া, নারিকেল, সুপারি, আম, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি এ বনের অন্তর্ভুক্ত।
৪. সড়ক ও বাঁধ বন :
সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বনবিভাগ, কৃষিবিভাগ এবং বিভিন্ন এনজিওদের প্রচেষ্টায় রাস্তাঘাট ও খাস জমিতে যে বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয়ে আসছে তাকে সড়ক বাঁধ বনায়ন বলে।
এক্ষেত্রে বনায়নকারী ৬০% এবং সরকার ৪০% উৎপন্ন দ্রব্য পেয়ে থাকে। প্রধানত রেইন ট্রি, কড়ই, শিশু, আকাশমণি, ম্যানজিয়াম, অর্জুন ইত্যাদি বৃক্ষ লাগিয়ে সড়ক ও বাঁধ বন সৃষ্টি করা হয় ।