উত্তর : ভূমিকা : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হলেও পূর্ব বাংলার জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় নি। কেননা পাকিস্তানের মূল ক্ষমতায় থেকে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা। তাদের সীমাহীন শাসন-শোষণ ও নিপীড়নের ফলে দু’অঞ্চলের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হয়।পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণের কারণে এক সময়ের সমৃদ্ধিশালী বাংলা অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ হয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক শিকারে পরিণত হয়।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক বৈষম্য :
নিম্নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক বৈষম্য আলোচনা করা হলো :
১. অগণতান্ত্রিক শাসন কার্যাবলি :
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী অগণতান্ত্রিকভাবে পূর্ববাংলায় শাসনকার্য পরিচালনা করে। ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন অনুসারে পাকিস্তানে একটি কেন্দ্রীয় আইনসভা এবং প্রত্যেক প্রদেশে একটি করে প্রাদেশিক আইনসভা ছিল। কেন্দ্রীয় আইনসভা তথা গণপরিষদের সদস্যগণ প্রাদেশিক আইনসভাগুলো কর্তৃক নির্বাচিত হতেন। প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যগণ ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববাংলার আইনসভার আয়ু বর্ধিত করার ফলে ১৯৫৪ সালের পূর্বে পূর্ববাংলায় কোনো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি। এমনকি ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে
মুসলিম লীগ প্রার্থী পরাজিত হওয়ার পর পূর্ববাংলার আইনসভায় যে ৩৪টি আসন শূন্য হয় তার কোনোটিতে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয় নি । ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগের অগণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত ছিল ।
২. রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা :
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর পূর্ববাংলার জনসাধারণের উপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্যাতন-নিপীড়নের স্টিমরোলার চালিয়ে দেওয়ার মাত্রা বৃদ্ধি করে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে বাঙালির কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার লক্ষ্যে সব ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে এবং বহু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হলে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় ।
৩. আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে নিয়ন্ত্রণ :
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার আমলাতন্ত্রের মাধ্যমেও পূর্ববাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করতো। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমলাগণ মুখ্য ভূমিকা পালন করতো। কিন্তু আমলা শ্রেণীতে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। ১৯৬৪ সালে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে মোট ১৭ জন সচিবের মধ্যে মাত্র ২ন ছিলেন বাঙালি ।
সচিবালয়ে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের মধ্যেও বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল মাত্র ২১%। ১৯৬৬ সালের মোট ৮০১ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র ১৭০ জন বাঙালি ছিলেন। ১৯৬৫ সালের দিকে কেন্দ্রীয় চাকরিতে সার্বিকভাবে বাঙালির সংখ্যা ছিল ২৪%। আইয়ুব শাসনামলে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ সীমিত থাকার ফলে এ আমলা শ্রেণী শাসন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করায় পূর্ববাংলার রাজনৈতিক অবস্থা চরম সংকটাপন্ন হয়ে উঠে।
৪. পূর্ববাংলার নিরাপত্তাহীনতা :
পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক শাসকচক্রের শোষণ ও রাজনৈতিক আধিপত্যের কারণে পূর্ববাংলার জনগণ যখন চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় নিমজ্জিত, তখন ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৭ দিনব্যাপী এ যুদ্ধের সময় পূর্ববাংলা পাকিস্তান তথা বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে । ফলে বাঙালিদের মনে গভীর নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলাকে শুধু শাসন ও শোষণ করার নীতি গ্রহণ করে। এ অঞ্চলের জনগণের অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য তারা কোনো ভূমিকা রাখে নি ।
৫. পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রতারণা :
পূর্ববাংলার জনগণ যখনই তাদের ন্যায্য অধিকারের
দাবি তুলেছে, তখনই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও কায়েমি স্বার্থবাদীরা ঐসব দাবির পশ্চাতে ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের কাল্পনিক ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে জনগণের সাথে প্রতারণা করেছে। বাঙালির ন্যায্য দাবি না মিটিয়ে তাদের কণ্ঠরোধ করার জন্য সরকার নির্যাতনমূলক দমননীতি গ্রহণ করেছে। পূর্ববাংলার জনগণের অধিকার আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখার জন্য সরকার ১৪৪ ধারা জারি, মিছিলে পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ, রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার প্রভৃতির মাধ্যমেও বাঙালিকে ঠেকাতে না পেরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বারবার পূর্ববাংলার জনসাধারণের সাথে রাজনৈতিক প্রতারণা করেছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি কেন্দ্রীয়
শাসকগোষ্ঠী নানা অজুহাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নি; বরং তারা বাঙালিদের সাথে প্রদত্ত ওয়াদা ভেঙে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা চালায় ।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বৈষম্য নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বৈষম্য আলোচনা
করা হলো :
১. রিক্রুটিং এজেন্সিতে পশ্চিমাদের আধিপত্য :
সামরিক প্রতিষ্ঠান ও রিক্রুটিং এজেন্সিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। প্রতিরক্ষা বিভাগের সকল শাখার সদর দপ্তর, অস্ত্র কারখানা সবই ছিল পশ্চিম
পকিস্তানে । প্রতিরক্ষা ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলোও পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ছিল। যার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সহসা বাঙালিদেরকে অফিসার পদে নিয়োগ দিত না ।
২. নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য :
নিউ ফ মু লা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (আবশ্যিক) নিউ ফর্মুলা
সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্যকে পাঞ্জাব থেকে নিয়োগ দেওয়া হতো। ১৯৬৫ সালে মোট ১৭ জন জেনারেল, লে. জেনারেল ও মেজর জেনারেলের মধ্যে মাত্র ১ জন মেজর জেনারেল ছিলেন বাঙালি। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর অফিসার শ্রেণীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল যথাক্রমে ৫%, ১০% ও ১৬%। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯৫% ছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, আর মাত্র ৫% ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়োগকৃত ।
৩. নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বৈষম্য :
১৯৬০-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বাজেটের ৫৬% প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করা হলেও পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় মাত্র ১০%। যার কারণে ১৯৬৫ সালে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী
পূর্ববাংলাকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে পাক-ভারত যুদ্ধে লিপ্ত হয় ।
৪. প্রতিরক্ষা বিভাগে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করা :
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চার বছর পর্যন্ত বাঙালিদের মাত্র ৮১০ জনকে প্রতিরক্ষা বিভাগে চাকরি প্রদান করা হয়। বাঙালিদেরকে প্রতিরক্ষা বিভাগের চাকরি থেকে দূরে সরিয়ে
রাখার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়। যেমন-
(i) প্রতিরক্ষা বিভাগের চাকরির জন্য নাম লেখাতে পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে হতো ।
প্রতিরক্ষা সার্ভিসে প্রবেশের জন্য বাঙালিদের কোনো রকম উৎসাহ দেওয়া হতো না ।
(iii) প্রতিরক্ষা বিভাগের সকল সদর দফতর পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপন করা হয়েছিল ।
(iv) প্রতিরক্ষা বিভাগে নিযুক্ত বেশির ভাগ সদস্যকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়োগ দেওয়া হতো। ফলে ২০-২২ বছর বয়সী যুবকেরা নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে চাকরি করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলত ।
৫. দৈহিক যোগ্যতা :
যেসব বোর্ডের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সার্ভিসে নিয়োগ করা হতো তাদের প্রায় সকল সদস্যই
ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি । তারা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রার্থীদের এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিত। তাছাড়া সামরিক বাহিনীর জোয়ান পদে এমন সব দৈহিক যোগ্যতা আরোপ করা হতো যা বাঙালি ছেলেদের থাকত না। যার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের পদচারণা ছিল খুবই কম।
৬. নিয়োগের ক্ষেত্রে পাঞ্জাবিদের প্রাধান্য :
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে বাঙালিরা খুবই অবহেলিত ছিল । পশ্চিম পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করতো যে, বাঙালিরা পশতুন বা পাঞ্জাবিদের মতো ‘সাহসী’ নয় । তাই সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৭% এরও কম এবং অফিসার পর্যায় প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। সশস্ত্র বাহিনীর ৮৫% সদস্যই ছিল পাঞ্জাবি । যা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের সাক্ষ্য বহন করে।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থান্বেষী মহল পূর্ববাংলার গণমানুষের অধিকার হরণ করে তাদের রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত করে। তাছাড়া সামরিক বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে তারা ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি করে। অর্থাৎ পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করার ফলে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে চরম দুরবস্থা সৃষ্টি হয়