মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশ কে জারি করেন
আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের প্রকৃতি:
ভূমিকা : ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে জেনারেল আইয়ূব খান পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। তার ছিল সুদূর রাজনৈতিক অভিলাস। তিনি ১৯৫৯ সালের ২৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি পদে
অধিষ্ঠিত হয়ে স্থানীয় সরকার কাঠামো সংস্কারের নামে যে নীতি গ্রহণ করেন সেটাই ইতিহাসে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে পরিচিত। এখানে যতটা না ছিল স্থানীয় সরকার কাঠামোর সংস্কার সাধন তার চেয়ে বেশি ছিল আইয়ুব সরকারের ক্ষমতাকে স্থায়ীকরণের ব্যবস্থা। এ ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ প্রকৃতপক্ষে কখনো মৌলিক গণতন্ত্র ছিল না। তা ছিল স্বার্থবাদী একটি শ্রেণী তৈরির মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করা।
আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র :
পদে সমাসীন হওয়ার এক বছর পরে ১৯৫৯ সালের ২৭ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল বা তথাকথিত বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী আইয়ুব খান সামরিক আইন প্রশাসক থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের উপলক্ষে পাকিস্তানে যে নতুন ধরনের গণতন্ত্র প্রবর্তনের ঘোষণা দেন তাই ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে পরিচিত। গণতন্ত্র সম্পর্কে আইয়ুব খানের নিজস্ব চিন্তাধারা ও বহুদিনের উদ্ভাবিত পরিকল্পনার ফলশ্রুতি ছিল মৌলিক গণতন্ত্র। জনগণের ইচ্ছাকে সরকারের কাছাকাছি এবং সরকারি কর্মকর্তাদেরকে জনগণের কাছে এনে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা করাই ছিল মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থাকে চারটি স্তরে বিভক্ত করে প্রশাসন ব্যবস্থাকে অধিকতর গণমুখী করার জন্য গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াই ছিল মৌলিক গণতন্ত্র। মৌলিক গণতন্ত্রের মূলে নিহিত রয়েছে গ্রাম।
গ্রাম থেকেই এর বুনিয়াদ গড়ে উঠে বলে এ ব্যবস্থা বুনিয়াদি গণতন্ত্র নামেও অভিহিত।
মৌলিক গণতন্ত্রের প্রকৃতি বা স্তরবিন্যাস :
মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা আইয়ুব খানের অভিনব সৃষ্টি। মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চারটি স্তরে বিভক্ত ছিল।যথা-
১. গ্রামীণ পর্যায়ে ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং শহর এলাকায় টাউন ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন।
২. পূর্ব পাকিস্তানে থানা কাউন্সিল ও পশ্চিম পাকিস্তানে তহশিল কাউন্সিল গঠন,
৩.জেলা কাউন্সিল গঠন,
৪. বিভাগীয় কাউন্সিল।
সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিকেন্দ্রীভূত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার এ স্তরসমূহ বিশ্লেষণ করলে মৌলিক গণতন্ত্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আরো সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে। মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চারটি স্তর
নিম্নে আলোচিত হলো :
১. ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং টাউন ও ইউনিয়ন কমিটি : মৌলিক গণতন্ত্রের সর্বনিম্ন ও গুরুত্বপূর্ণ স্তর ছিল ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং টাউন ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়। দশ হাজার থেকে পনেরো হাজার সংখ্যক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলের সীমানা নির্ধারিত হয়। ১৫ জন সদস্য নিয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠিত হওয়ার কথা বলা হয়। তার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়। ১২০০ থেকে ১৫০০ জন ভোটদাতার প্রতিনিধি হিসেবে একজন সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কথা বলা হয়। এভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৪০,০০০ জন করে মোট ৮০,০০০ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হতেন। সমগ্র পাকিস্তানের এই ৮০ হাজার প্রতিনিধিই মৌলিক গণতন্ত্রী নামে পরিচিত ছিল।
নির্বাচিত মৌলিক গণতন্ত্রী ইলেক্টরাল কলেজ (Electoral College) হিসেবে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচনের এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটারে পরিণত হয়। ১৯৬২ সালের সংবিধান কার্যকরী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইউনিয়ন কাউন্সিলের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য সরকার কর্তৃক মনোনীত হতেন। নির্বাচিত মৌলিক গণতন্ত্রীরা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করতেন। অন্যদিকে যেসব শহরে পৌরসভা নেই সেখানে টাউন কমিটি এবং যেসব শহরে পৌরসভা আছে সেখানে ইউনিয়ন কমিটি গঠন করা হয়। তবে মৌলিক গণতন্ত্রের সর্বনিম্ন এ পর্যায়ে গ্রামভিত্তিক ইউনিয়ন কাউন্সিলই ইউনিয়নের জনসাধারণের সার্বিক উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। গ্রাম পুলিশের সহায়তায় ইউনিয়ন কাউন্সিল ইউনিয়নে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখে। ইউনিয়ন কাউন্সিলসমূহ সালিসি আদালত গঠনপূর্বক ছোটখাটো ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার নিষ্পত্তির অধিকারী হয়। নিজস্ব কর্মকাণ্ডের ব্যয় নির্বাহের জন্য ইউনিয়ন কাউন্সিল জনসাধারণের উপর বিভিন্ন কর আরোপের ও তা আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে।
২. থানা কাউন্সিল এবং তহশিল কাউন্সিল : মৌলিক গণতন্ত্র কাঠামোতে ইউনিয়ন কাউন্সিলের পরবর্তী ধাপ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে থানা কাউন্সিল এবং পশ্চিম পাকিস্তানে তহশিল কাউন্সিল। সংশ্লিষ্ট থানা বা তহশিলের অন্তর্গত সকল ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সমসংখ্যক বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা সমন্বয়ে থানা ও তহশিল কাউন্সিল গঠিত হয়। মহকুমা প্রশাসক থানা কাউন্সিলের সভাপতি এবং তহশিলদার তহশিল কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তবে স্থানীয় সার্কেল অফিসার পদাধিকার বলে থানা কাউন্সিলের সদস্য হতেন এবং তিনি সভাপতির অনুপস্থিতিতে থানা কাউন্সিলের বৈঠকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। থানা বা তহশিলের অন্তর্গত ইউনিয়নগুলোর কাজের সমন্বয় সাধন করাই ছিল থানা কাউন্সিলের অন্যতম কাজ।
৩. জেলা কাউন্সিল : মৌলিক গণতন্ত্রে থানা কাউন্সিলের পরবর্তী ধাপ ছিল জেলা কাউন্সিল। জেলা কাউন্সিলের সর্বাধিক সদস্যসংখ্যা ছিল ৪০। এ ৪০ জনের মধ্যে অর্ধেক সদস্য ছিল জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা, বাকি অর্ধেক ছিলেন বেসরকারি সদস্য। বেসরকারি সদস্যরা জেলার অন্তর্গত বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিল, টাউন কমিটি ও ইউনিয়ন কমিটির চেয়ারম্যানদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত হতেন। ডেপুটি কমিশনার জেলা কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন। জেলা কাউন্সিলের বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক এ দুই ধরনের দায়িত্ব ছিল। মৌলিক গণতন্ত্র অর্ডার-এর চতুর্থ তফশিলের প্রথম অংশে বাধ্যতামূলক কার্য এবং ২য় অংশে ঐচ্ছিক কার্যাবলির বিবরণ উল্লিখিত হয়েছে। বাধ্যতামূলক দায়িত্বসমূহের মধ্যে আছে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার, জনস্বাস্থ্য রক্ষা, রাস্তাঘাট, কালভার্ট ও ব্রিজ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ। মৌলিক গণতন্ত্র কাঠামোর সর্বোচ্চ স্তর ছিল বিভাগীয় কাউন্সিল। এ কাউন্সিলের
৪. বিভাগীয় কাউন্সিল: সর্বোচ্চ সদস্যসংখ্যা ছিল ৪৫ জন। মোট সদস্যের অর্ধেক সরকার কর্তৃক মনোনীত সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হতো। বিশেষ করে বিভাগের অন্তর্গত জেলা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং বিভিন্ন উন্নয়ন দপ্তরের প্রতিনিধিরা
ছিলেন সরকারি সদস্য।
আর বেসরকারি সদস্যের অন্তত অর্ধেক বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়াম্যানদের মধ্য হতে মনোনীত হতেন। বিভাগীয় কমিশনার পদাধিকার বলে বিভাগীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালন করতেন। বিভাগের অন্তর্গত বিভিন্ন জেলা কাউন্সিলগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করাই ছিল বিভাগীয় কাউন্সিলের অন্যতম কাজ।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা আইয়ুব খানের অভিনব সৃষ্টি। ইস্কান্দার মির্জাকে অপসারিত করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদি করার মানসে আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালের ২৭ অক্টোবর মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হলেও এ ব্যবস্থার মাধ্যমে
আইয়ুব খান তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা পর্যন্ত নিজ অনুগত সৃষ্টি করার মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ ও দীর্ঘমেয়াদি করতে চেয়েছিলেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের জন্য পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস PDF :
দয়া করে ১ মিনিট অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষন এর মধ্যে আপনাকে ডাউনলোড পেইজ এ নিয়ে যাওয়া হবে। আপনাকে নিয়ে যাওয়ার পর আপনাকে হবে এই পেইজে ডাউনলোড লিংক দেওয়া হবে তাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। ধন্যবাদ। আরো অন্যান্য বই গুলো নেওয়ার জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। ধন্যবাদ আপনাকে দয়া করে ১ মিনিট অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষন এর মধ্যে আপনাকে ডাউনলোড পেইজ এ নিয়ে যাওয়া হ