মুক্তিযুদ্ধের কারণ
উত্তর : ভূমিকা : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতীয় জীবনের সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা পাকিস্তানি শাসকqগোষ্ঠীর অত্যাচার, শোষণ আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনসাধারণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার এক চূড়ান্ত ও দুর্বার সংগ্রামই ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও বিপুল আত্মোৎসর্গের মধ্য দিয়ে মুক্তিলাভ করে বাংলার মানুষ, মুক্ত হয় বাংলার মাটি এবং পৃথিবীর বুকে জন্মলাভ করে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কারণ : বাঙালিরা দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের পরাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য ছিনিয়ে আনে। এই স্বাধীনতা যুদ্ধের পশ্চাতে যেসব কারণ বিদ্যমান ছিল তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. অর্থনৈতিক কারণ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পশ্চাতে পূর্ববাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি অনেকাংশে দায়ী ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানিরা শাসকগোষ্ঠীর নিকট থেকে সীমাহীন অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের সকল কার্যালয় ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানাদির প্রধান কেন্দ্রগুলো অবস্থিত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে । অথচ পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত অর্থ দিয়ে এসব উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. সামাজিক কারণ : দু’অঞ্চলের সামাজিক বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানিদেরকে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেছিল। বস্তুতপক্ষে পাকিস্তানের দু’প্রদেশে দু’ধরনের সমাজ বিদ্যমান ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের জীবনযাত্রার মান ছিল পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় অনেক উন্নত। সরকারি নীতিমালাও বাস্তবায়িত হতো পূর্ব পাকিস্তানিদের দমন করে রাখার জন্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে বেশি ছিল। এসব কারণে বাঙালিরা পাকিস্তানের সাথে শুধু ধর্মীয় ‘ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে’ আবদ্ধ থাকার ব্যাপারে অনিচ্ছা প্রকাশ করতে থাকলে শুরু হয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ববাংলার ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে ধ্বংস ৩. সাংস্কৃতিক কারণ : করতে পাকিস্তানি শাসকচক্র তৎপর হয়ে উঠে। তাদের এ তৎপরতার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে ১৯৫২ সালে বাংলার ছাত্র-জনতা যে ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলে তা সমগ্র বাঙালি মানসে গভীর সচেতনতাবোধ জাগ্রত করে। আর এ সচেতনতা থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।
৪. রাজনৈতিক কারণ : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের মধ্যে যে ঐক্যবোধ গড়ে উঠে, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের মধ্য দিয়ে তা আরো সুদৃঢ় হয়। এছাড়া ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯- এর গণভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী রায় অগ্রাহ্য, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি কারণে বাঙালিরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাংলার শোষিত জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রত্যক্ষ ও সশস্ত্র বহিঃপ্রকাশ। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে অসাম্যের বিরুদ্ধে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঙালিদের দীর্ঘদিনের প্রয়াসের চূড়ান্ত রূপই হলো এই মুক্তিযুদ্ধ। এ মুক্তিযুদ্ধের ফলেই এক সাগর রক্ত আর লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।