সংকর বা মিশ্র জাতি:
বাঙালি জাতির নৃগােষ্ঠীগত পরিচয় অল্প কথায় বিশ্লেষণ করা কঠিন। বাঙালি নরগােষ্ঠী বহুকাল ধরে নানা জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন জাতিবর্ণের রক্তপ্রবাহ বাঙালি জাতির ধমনীতে সঞ্চারিত হয়েছে। এ কারণে কোনাে কোনাে তাত্ত্বিক বাঙালি জাতিকে সংকর জাতি হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বাঙালিকে সংকর বা মিশ্র-জাতি বলার কারণ : বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর সমন্বয়ে যে জাতির উদ্ভব ঘটায়, তাদেরকে সংকর জাতি বলা হয়। বাঙালিকে সংকর বা মিশ্র জাতি বলার কারণসমূহ নিয়ে আলােচনা করা হলাে :
১. আদি অস্ট্রীয় প্রভাব :
বাংদেশের অধিবাসীদের মধ্যে আদি অস্ট্রীয় প্রভাব বিদ্যমান। শ্রীলঙ্কার ভেড্ডিড জাতির সাথে এদের সাদৃশ্য রয়েছে। এদের বৈশিষ্ট্য হলাে লম্বাকৃতির মাথা, চওড়া নাক, গায়ের রং কালাে, গড়নে বেঁটে বা মধ্যাকৃতি । বাংলাদেশের গারাে, সাঁওতাল, ওরাও এবং কিছু সমতলবাসীর মাঝে এ ধরনের দৈহিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
২. মােঙ্গল দ্রাবিড় গােষ্ঠীর প্রভাব :
বাংলাদেশের অধিবাসীদের মধ্যে মঙ্গোলীয় প্রভাব লক্ষ করা যায় । মঙ্গোলীয়রা পীতবর্ণের। গােল মাথা, ক্ষুদ্রাকৃতি চোখ, চোয়ালের উঁচু হাড়ের প্রভাব এ দেশের জনগােষ্ঠীর মধ্যে কমবেশি লক্ষ করা যায়। রিজলের মতে বাঙালিরা মােঙ্গল দ্রাবিড় প্রভাবিত এক সংকর জাতি।
৩. আর্য ভাষা ভাষীদের প্রভাব :
আর্যরা দ্রাবিড় ভেন্ড্রিডদের পদানত করে এবং ভারতবর্ষে বর্ণপ্রথার সৃষ্টি করে। তাই অনেকের ধারণা বাংলাদেশী জনগােষ্ঠীর উপর আর্য ভাষাভাষীদের প্রভাব রয়েছে।
৪. আলপাইন নরগােষ্ঠীর প্রভাব :
নৃবিজ্ঞানী হুটন উপমহাদেশের জনগােষ্ঠীকে যে আট ভাগে ভাগ করেছেন তন্মধ্যে আলপাইন একটি। তিনি নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, আলপাইন মানবগােষ্ঠীর সাথে বাঙালি জনগােষ্ঠীর অনেক দৈহিক মিল রয়েছে।
৫. বহিরাগত মুসলমানদের প্রভাব :
অষ্টম ও নবম শতকে এদেশে বাইরের বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে পীর, আউলিয়া ও তাদের শিষ্যরা এসেছিলেন। তাই ধারণা করা হয় ঐসব তুর্কি, আফগান, মুঘল, আরব, আবিসিনীয়, ইরানি জনগােষ্ঠীর প্রভাব এদেশের মধ্যে রয়েছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের জনগােষ্ঠীর মধ্যে সুপ্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন নৃগােষ্ঠীর প্রভাব বিদ্যমান। মূলত বৈচিত্র্যময় পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর সঙ্গে মেলামেশার ফলে বাঙালি পরিণত হয়েছে একটি সংকর বা মিশ্র-জাতিতে। তাই বাঙালি হচ্ছে নানা গােত্রভুক্ত মানুষের রক্তের মিশ্রণজাত এবং এক বিচিত্র জনগােষ্ঠী। এসব কারণে। বাঙালি জাতিকে একটি মিশ্র জাতি বা সংকর জাতি বলা হয়।