পাঠ-৫.৬ : মানবাধিকার কি
Human Rights:
১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র’ অনুমোদন করে।
এই দলিলটি গৃহীত হওয়ার সময় কোনো রাষ্ট্র ভেটো দেয়নি, যদিও আটটি রাষ্ট্র ভোটদান থেকে বিরত ছিল।
তখন থেকে আজ পর্যন্ত জাতিসংঘ ২০০টিরও বেশি মানবাধিকারসংক্রান্ত চুক্তি, কনভেনশন ও সনদ অনুমোদন করেছে।
এভাবে মানবাধিকার ধারণাটি সারা বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ মানবাধিকারের উপর গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে বলেন, “বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার সুরক্ষা একটি সর্বজনীন নৈতিক মানদণ্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।”
মানবাধিকার রাষ্ট্রের মতো একটি পুরনো ধারণা। এটি নিয়ে মনীষীদের দৃষ্টিভঙ্গি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন অবাধ্য হলে দাসদের নির্যাতন করার অধিকার ছিল।
কিন্তু বর্তমানে এটাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা এথেন্সের কথা নিয়ে আসতে পারি।
একসময় গ্রিক রাষ্ট্র এথেন্সে মনিবদের হচ্ছে। মোটকথা, মানবাধিকারের মূল বক্তব্য হলো জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ এবং ভাষা-নির্বিশেষে সব মানুষের প্রদর্শন করা।
মানবাধিকার বিষয়টি আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণ হয়েছে।
তাই এটাকে বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
জাতিসংঘের মতে, “Human rights could be generally defined as those rights which are inherent in ou nature and without which we cannot live as human beings.
অর্থাৎ, “মানবাধিকার বলতে সেসব অধিকারে বোঝায় যা মানুষের প্রকৃতির সাথে জড়িত এবং এটা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না।”
স্কট ডেভিডসন বলেন, “The concept of human rights is closely related with the protection of individuals from the exercise of state, government or authority in certain areas of their lives.”
অধ্যাপক আপাদোরাই (Appadorai) বলেন, “মানবাধিকার হলো প্রকৃতির শাশ্বত ও সর্বজনীন রূপ, যা মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজন।”
একক কাজ : জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক আনুমানিক কতটি চুক্তি, কনভেনশন ও সনদ অনুমোদন করেছে? তালিকা তৈরি কর।
মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের সম্পর্ক
Relation Between Fundamental Rights and Human Rights:
রাষ্ট্রের নাগরিকের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য মৌলিক অধিকার অপরিহার্য।
মৌলিক অধিকার হলো রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত নাগরিকদের সেসব সুযোগ-সুবিধা, যা নাগরিকদের বেঁচে থাকা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য প্রয়োজন।
মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও বলবৎযোগ্য। সংবিধান স্থগিত বা জরুরি অবস্থা ঘোষণা ছাড়া রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক অধিকার বাতিল করতে পারে না।
অপরদিকে মানবাধিকার হলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জাতি- ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন-নির্বিশেষে সকল ব্যক্তির অধিকার।
মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য খুবই কম। মানুষের কল্যাণসাধনই উভয় ধরনের অধিকারের মূল উদ্দেশ্য।
মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের ঘোষণাও সৃষ্টি হয়েছে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও জীবনের পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত অধিকাংশ মানবাধিকারই মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
আবার বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের সংবিধানে সন্নিবেশিত মৌলিক অধিকারসমূহ মানবাধিকারের মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তবে কতকগুলো বিষয়ে মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যা নিম্নরূপ-
১। রাষ্ট্রের সংবিধান কর্তৃক মৌলিক অধিকার স্বীকৃত ও রক্ষিত হয়। কিন্তু মানবাধিকার জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত ও রক্ষিত।
২। মৌলিক অধিকারের পরিধি রাষ্ট্রীয় সীমানায় আবদ্ধ। অপরদিকে মানবাধিকারের পরিধি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত।
৩। মানবাধিকারের চেয়ে মৌলিক অধিকার সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও সুরক্ষিত।
৪। মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে সেগুলো আদালত কর্তৃক বলবৎ করা হয়। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে সহজে তা বলবৎ করা যায় না।
৫। রাষ্ট্রীয় চেতনাবোধ থেকে মৌলিক অধিকার বিকাশ লাভ করে। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক চেতনাবোধ থেকে মানবাধিকার বিকাশ লাভ করে।
৬। মৌলিক অধিকারের বলে কোনো ব্যক্তি অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে না।
কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তি নিজ রাষ্ট্রে নিরাপদ বোধ না করে তাহলে মানবাধিকারের বলে অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয় চাইতে পারে ।
৭। মৌলিক অধিকার একেক রাষ্ট্রে একেক রকম হতে পারে। কিন্তু মানবাধিকার জাতিসংঘের সদস্য সকল রাষ্ট্রের জন্য একই রকম।
মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের মধ্যে উপর্যুক্ত পার্থক্য থাকলেও একে অপরকে প্রভাবিত করে।
মৌলিক অধিকারের ধারণা থেকেই মানবাধিকারের সৃষ্টি। আবার মানবাধিকারসমূহ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মৌলিক অধিকারের কামনাকে বেগবান করে তোলে।
সুতরাং মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার একে অপরের পরিপূরক।