প্রশ্ন ॥২.০৫ বাজারজাতকরণ পরিবেশের প্রকারভেদ আলোচনা কর।
অথবা, বাজারজাতকরণ পরিবেশ কত প্রকার ও কি
উত্তর : পণ্য, সেবা, ধারণা বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে যে সমস্ত বাহ্যিক এবং সম্ভাব্য পক্ষ, শক্তি, সত্তা বা পারিপার্শ্বিক উপাদান প্রভাব বিস্তার করে, তাদের সমষ্টিকে বাজারজাতকরণ পরিবেশ বলে। অর্থাৎ বাজারজাতকরণ পরিবেশকে নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করা যায় ।
বাজারজাতকরণ পরিবেশ = সুযোগসমূহ + হুমকিসমূহ পণ্যের বাজারজাতকরণ প্রভাব
→ সংগঠনের উদ্দেশ্য অর্জন
(ক) ব্যষ্টিক পরিবেশ একটি প্রতিষ্ঠানের বাজারজাতকরণ কার্যক্রমকে যে সকল উপাদান প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে সেগুলোর সমষ্টিকে ব্যষ্টিক পরিবেশ বলে।
ব্যষ্টিক পরিবেশকে ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। যথা
১. কোম্পানি (Company)
২. সরবরাহকারী (Supplier)
৩. মধ্যস্থকারবারি (Intermediaries)
৪. ক্রেতার বাজার (Customers market)
৫. প্রতিযোগী (Competitioners )
৬. জনগোষ্ঠী (Public)
→ নিম্নে এদের বর্ণনা করা হল-
১. কোম্পানি: কোম্পানি বাজারজাতকরণ পরিবেশের একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। যে কোন কোম্পানিতে বিভিন্ন বিভাগ থাকে এবং এ বিভাগগুলো বিভিন্নভাবে বাজারজাতকরণ পরিবেশকে প্রভাবিত করে। কোম্পানিকে তার কার্যাবলি সুচারুরূপে সম্পাদন
করার জন্য বিভিন্ন বিভাগ; যেমন: বিক্রয় বিভাগ, গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ, উৎপাদন বিভাগ, হিসাব বিভাগ ইত্যাদি বিভাগের সাথে সম্পর্ক এবং সমন্বয়সাধন করে থাকে।
২. সরবরাহকারী:কোম্পানির পণ্য ও সেবা উৎপাদনে ব্যবহারের জন্য কাঁচামাল বিভিন্ন সরবরাহকারী যোগান দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠানের জন্য কাঁচামাল হিসেবে কাপড়, সুতা, বোতাম ইত্যাদি বিভিন্ন উৎস হতে সংগ্রহ করতে হয়।
৩. মধ্যস্থকারবারিগণ : বাজারজাতকরণে মধ্যস্থকারবারিগণ হচ্ছে ঐ সমস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যাদের সাহায্য ও সহায়তায় পণ্যসামগ্রী চূড়ান্ত ভোক্তার কাছে বিক্রয় বা বণ্টন হয়ে থাকে।
৪. ক্রেতাসাধারণ: কোম্পানি বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ক্রেতাসাধারণকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে ক্রেতা বাজারে কার্যক্রম চালায়।
প্রথমত, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যারা ভোগের জন্য দ্রব্যসামগ্রী। ক্রয় করে তারা ভোক্তা বাজার গঠন করে।
দ্বিতীয়ত, পুনঃ প্রক্রিয়াজাতকরণ বা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহারের জন্য ক্রয় করলে তাতে শিল্প বাজার গঠিত হয়।
তৃতীয়ত, পুনঃবিক্রয়ের জন্য দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করলে তাতে পুনঃবিক্রেতার বাজার গঠিত হয়।
চতুর্থত, সরকার জনসেবা কার্যক্রম চালানোর জন্য দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করলে তাতে সরকারি বাজার গঠিত হয়।
পঞ্চমত, বিদেশে অবস্থিত ভোক্তা, উৎপাদক, পুনঃবিক্রয়কারী ও সরকারি সংস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার গঠিত হয় ।
৫. প্রতিযোগী : প্রতিনিয়ত প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হয়। এ যে কোন প্রতিষ্ঠান অন্যান্য প্রতিযোগীদের তুলনায় ভালভাবে ভোক্তাদের সন্তুষ্টি প্রদান করতে চায়। এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান শুধু ক্রেতার চাহিদাকে অভিযোজন করলে চলবে না, বরং প্রতিযোগীদের কৌশলও অভিযোজন করতে হবে।
৬. জনসাধারণ: জনসাধারণ হলো কোন দল বা গোষ্ঠী যারা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। এ সমস্ত দল ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। বিভিন্ন জনসাধারণকে নিচের চিত্রের মাধ্যমে দেখানো যেতে পারে। অর্থসংস্থানকারী জনসাধারণ অর্থ যোগান ক্ষমতার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে; যেমন: ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। গণমাধ্যমে জনসাধারণ খবর, নিবন্ধন ও অন্যান্য তথ্যাদি সরবরাহ করে থাকে। যেমন : সংবাদপত্র, সাময়িকী, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি ।
পরিশেষে বলা যায়, কোম্পানির সার্বিক বাজারজাতকরণ কার্যক্রমকে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য ব্যষ্টিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানগুলোর সাথে অবশ্যই গভীরভাবে সমন্বয়সাধন করতে হয়। কারণ ব্যষ্টিক পরিবেশের উপাদানগুলো বাজারজাতকরণ কার্যক্রমে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে।
(খ) সামষ্টিক পরিবেশ : সামষ্টিক পরিবেশ বলতে এমন এক ধরনের কতিপয় শক্তির সমষ্টিকে বুঝায় যা প্রতিষ্ঠানের ব্যাধির পরিবেশের অন্তর্গত পক্ষগুলোকে প্রভাবিত করে এবং এই শক্তিগুলো নিজেরাই আলাদা পরিবেশ সৃষ্টি করে তাকেই সামষ্টিক পরিবেশ বলে।
সামষ্টিক পরিবেশকে ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. জনসংখ্যাবিষয়ক পরিবেশ (Demographic environment)
২. অর্থনৈতিক পরিবেশ (Economic environment)
৩. প্রকৃতিক পরিবেশ (Natural environment)
৪. প্রযুক্তিগত পরিবেশ (Technological environment)
৫. রাজনৈতিক পরিবেশ (Political environment)
৬. সাংস্কৃতিক পরিবেশ (Cultural environment)
নিম্নে বর্ণনা করা হল-
১. জনসংখ্যা বিষয়ক পরিবেশ :বাজারজাতকারীর জন্য প্রথম এবং প্রধান বিষয় হলো জনসংখ্যা। কারণ জনসংখ্যা ব্যতীত বাজারের প্রশ্নই আসে না। যে কোন পণ্য বাজারজাত করার পূর্বে বাজারজাতকারীর জনসংখ্যা সম্পর্কিত যে সমস্ত বিষয় জানা প্রয়োজন বা বিবেচনা করা উচিত তা হচ্ছে:
(ক) জনগণের ভৌগোলিক অবস্থান;
(খ) জনসংখ্যার ঘনত্বঃ
(গ) জনসংখ্যার গতিশীলতার ধারা;
(ঘ) বিভিন্ন বয়সের জনসংখ্যা:
(ঙ) জন্মহার এবং মৃত্যুহার;
(চ) জাতিগত বৈষম্য:
(ছ) ধর্মগত অবস্থান।
২. অর্থনৈতিক পরিবেশ: বাজারে কেবল লোকজন থাকলেই চলবে না, সাথে সাথে তাদের ক্রয়ক্ষমতা ব্যতীত বাজার অর্থহীন। সুতরাং পণ্যের বাজারজাতকরণে ক্রেতার অর্থনৈতিক অবস্থাও প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যে কোন পণ্য বাজারজাতকরণের প্রাক্কালে বাজারজাতকারীকে অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে যা জানতে হয় তা হলো :
(ক) যে এলাকায় পণ্যটি বাজারজাত করা হবে সেখানকার লোকদের আয়ের প্রকৃত অবস্থা;
(খ) কাদের আয় কোন্ স্তরে
(গ) বাজারে মুদ্রাস্ফীতি আছে কি না
(ঘ) লোকদের সঞ্চয়ের অভ্যাস কেমন এবং সঞ্চয়ের প্রকৃতি কিরূপ এবং
(ঙ) উপার্জিত আয়ের কত অংশ তারা ভোগের জন্য ব্যয় করে।
৩. প্রাকৃতিক পরিবেশ : কোন দেশের জলবায়ু, আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সম্পদ, নদনদী ইত্যাদির সমন্বয়েই উক্ত দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ গঠিত। প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্ধারণ করে কোন অঞ্চলের বা দেশের লোকের জীবনযাত্রা ও ভোগের ধরন। প্রাকৃতিক পরিবেশ যেহেতু লোকের জীবনযাত্রা ও ভোগ অভ্যাসকে প্রভাবিত করে সেহেতু এটা বাজারজাতকরণকেও প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে। কোন্ দেশে কি পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হবে ও বাজারজাত করা যাবে কি না তা সে বিশেষ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশে অনেকাংশেই নির্ধারণ করে। তাই বলা যায় যে, প্রাকৃতিক পরিবেশ বাজারজাতকরণকেও প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ বর্তমান যান্ত্রিক যুগে বাজারজাতকারীকে যে সকল সুবিধা দিচ্ছে সেগুলো হলো :
(ক) কাঁচামালের যোগান:
(খ) জ্বালানি ব্যয় হ্রাস ( প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল ইত্যাদির মাধ্যমে) এবং
(গ) পরিবেশ শোধন (প্রাকৃতিক উপায়ে গাছপালা, বনজঙ্গল ইত্যাদির মাধ্যমে ) ।
৪. প্রযুক্তিগত পরিবেশ : ‘মানবজীবনের সবচেয়ে নাটকীয় শক্তি হচ্ছে কারিগরি শক্তি। এ কারিগরি পরিবেশ পেনিসিলিন আবিষ্কার করে রোগ প্রতিরোধে সক্ষম হয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি আবিষ্কার করে মানুষকে চমৎকৃত করে দিয়েছে। ভূ-উপগ্রহের আবিষ্কারের মাধ্যমে ঘরে বসে পৃথিবীর কোথায় কখন কি হচ্ছে তা দেখা যাচ্ছে। প্রযুক্তিগত কোন আবিষ্কার, পরবর্তী সময়ে পূর্বে আবিষ্কৃত কোন জিনিসকে আবার ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় যার প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক।
৫. রাজনৈতিক পরিবেশ : রাজনৈতিক পরিবেশ পণ্য এবং সেবার বাজারজাতকরণের সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করে। রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত ব্যাপক এবং তা আইন, সরকারের প্রতিনিধি এবং প্রভাববিস্তাকারী দলের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে গঠিত যা সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে।
৬. সাংস্কৃতিক পরিবেশ : সামষ্টিক পরিবেশের আর একটি উপাদান হলো সাংস্কৃতিক পরিবেশ। একজন লোক যে সমাজে লালিত হয়ে বড় হয়ে উঠবে তার উপর সে সমাজের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রীতিনীতির প্রভাব পড়বে। বাজারজাতকারীকে সে অনুযায়ী পণ্য বাজারজাত করতে হবে। যে সমস্ত সাংস্কৃতিক উপাদান বাজারজাতকরণে প্রভাব রাখে তা হলো সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রীতিনীতি