উত্তর : ভূমিকা : ১৯৭০ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের মৃত্যুর বার্তাবাহক ছিল। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় পশ্চিমা শাসকবর্গের শোষণ ও দুঃশাসনের করালগ্রাস থেকে পূর্ববাংলার মানুষের স্বাধিকার ও মুক্তি লাভের বহিঃপ্রকাশ ছিল।
আওয়ামী লীগের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীকরূপে আত্মপ্রকাশ করায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ আওয়ামী লীগকে দেশের শাসনভার অর্পণ করতে চেয়েছিল। মূলত ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যা বাঙালিদেরকে অখণ্ড পাকিস্তানের পরিবর্তে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব :
নিম্নে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. সাধারণ নির্বাচন : পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল প্রথম সাধারণ নির্বাচন। এর পূর্বে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একই সাথে ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ নির্বাচনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
২. অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রভাব : আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অপরদিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৮টি আসন পায় । এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ যে, আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো আসন পায় নি, আবার পাকিস্তান পিপলস পার্টিও পূর্ব পাকিস্তানে কোনো আসন পায় নি। সুতরাং এ নির্বাচনে অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, যা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৩. জাতীয়তাবোধের উন্মেষ : সমগ্র বাঙালি জাতি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়। আলাদা আবাসভূমি ও স্বাধিকার আদায়ে সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ফলে বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়ে উঠে, যা ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।
৪. আত্মপ্রত্যয়ের সৃষ্টি : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয় লাভের মাধ্যমে বাঙালি জাতি আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠে যার ফলে বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
।
৫. ঔপনিবেশিক শাসন হতে মুক্তির বাসনা : বাঙালি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেলেও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে থাকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আওয়ামী লীগ বাঙালির সত্যিকারের প্রতিনিধি। যার ফলে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বিশ্ববাসীর জনসমর্থন লাভ করা সহজ হয়।
৬. পাকিস্তান ভাঙনের বার্তাবাহক : ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তানের উভয় অংশের জনগণ রাজনৈতিকভাবে একে অপরকে বিশ্বাস করে না। ফলে এ নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দ্বার উন্মোচিত হয় ।
৭. জাতীয় অনৈক্যের বহিঃপ্রকাশ : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এটাই প্রমাণিত হয় যে, আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় হলেও পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো জনপ্রিয়তা ছিল না । আবার ভুট্টোর পি.পি.পি সহ পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক কোনো দলেরই পূর্ব পাকিস্তানে জনসমর্থন ছিল না। তাই এ নির্বাচনে সুস্পষ্ট হয় যে, পাকিস্তানে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয় নি, যা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ভূমিকা রাখে ।
৮. সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টি : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করেন। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে জনগণ শাসন ক্ষমতায় তাদের প্রতিনিধিদের দেখতে চায়। কিন্তু এর ব্যতিক্রম হলে জনগণ বাধাগ্রস্ত হয়ে সংগ্রামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়।
৯. পাকিস্তানের ব্যর্থ প্রত্যাশা : পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে অন্যান্য দলের সাথে জোট বাঁধতে বাধ্য হবে। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে পাকিস্তানিদের সে প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথ প্রশস্ত হয়ে যায় ৷
১০. ছয় দফাকে স্বীকৃতি দান : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছয় দফাকে নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে ঘোষণা করে। বাঙালি তাদের মুক্তির সনদ ছয় দফাকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ত্বরান্বিত হয়।
১১. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন : ক্ষমতাসীন পাকিস্তান সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো রাজনৈতিক দল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় এ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ ছিল। ফলে জনগণ সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায় যা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
১২. বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের স্বীকৃতি : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ করেন, যা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বিশ্বজনসমর্থন আদায়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে ।
১৩. স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় : স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করলে শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ইয়াহিয়া খানের ইঙ্গিতে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সশস্ত্র সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু বাঙালিরা অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এ আঘাত সামলে নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে। দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের চরম বিকাশ সাধিত হয় এবং পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ স্পষ্ট হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতির স্বাধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে টালবাহানা শুরু করেন। অবশেষে ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালির উপর লেলিয়ে দেন। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী যুদ্ধ চলার পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।