বঙ্গভঙ্গ
ভূমিকা :
১৯০৫ সালের ৭ জুলাই’র বঙ্গ বিভাগ ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহের একটি। তৎকালে বঙ্গ প্রদেশ বলতে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা এবং মধ্য প্রদেশ ও আসামের কিছু অংশকে বুঝাত । এ প্রদেশের আয়তন ছিল ১,৭৯,০০০ বর্গমাইল । এ বৃহৎ প্রদেশকে একজন গভর্নরের পক্ষে শাসন করা ছিল দুরূহ ব্যাপার । তাই তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জন প্রশাসনিক সুবিধার্থে ১৯০৫ সালে বঙ্গ প্রদেশকে বিভক্ত করেন ।
বঙ্গভঙ্গ কি :
ব্রিটিশ ভারতে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত সর্ববৃহৎ প্রদেশ ছিল ‘বাংলা প্রেসিডেন্সি’ যার আয়তন ছিল ১ লক্ষ ৮৯ হাজার বর্গ মাইল এবং লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৭ কোটি ৯০ লাখ । বাংলা, বিহার, ছোট নাগপুর ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত এ প্রদেশের রাজধানী ছিল কলকাতা। বিশালায়তন এ প্রদেশের শাসনভার ন্যস্ত ছিল একজন গভর্নর বা ছোট লাটের ওপর যা তাঁর পক্ষে পরিচালনা করা ছিল খুবই দুরূহ। তাই প্রশাসনিক সুবিধার্থে ভারতের তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে ‘বাংলা প্রেসিডেন্সি’ নামক বৃহৎ প্রদেশকে দুটি স্বতন্ত্র প্রদেশে বিভক্ত করেন। যা উপমহাদেশের ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত ।
নবগঠিত প্রদেশ দুটির একটি হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিভাগ ও আসামকে নিয়ে “পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ” । এর রাজধানী হয় ঢাকা এবং প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হন স্যার জোসেফ ব্যামফিল্ড ফুলার । অন্যটি হচ্ছে পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ’, যার রাজধানী হয় কলকাতা এবং প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হন স্যার এনড্রো ফ্রেজার । ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করা হয় এবং কার্যকর হয় ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ থেকে ।
বঙ্গভঙ্গের কারণ :
বিরাট আয়তন ও বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাকে বিভক্ত করে দুটি প্রদেশ গঠন করার পিছনে ব্রিটিশ প্রতিনিধিগণ যদিও শুধুমাত্র প্রশাসনিক কারণের কথা উল্লেখ করেছেন, তথাপিও এর পিছনে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ বিদ্যমান ছিল।
নিম্নে কারণগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. প্রশাসনিক কারণ :
বঙ্গভঙ্গের পশ্চাতে ব্রিটিশ প্রতিনিধিবর্গ কর্তৃক উল্লিখিত প্রশাসনিক কারণসমূহ নিম্নরূপ :
(ক) বাংলা প্রদেশের আয়তনের বিশালতা :
অবিভক্ত বাংলা ছিল আয়তনের দিক দিয়ে উপমহাদেশের বৃহত্তম প্রদেশ। এর আয়তন ছিল দুই লাখ বর্গমাইল। কাজেই এ বিশাল প্রদেশে সুশাসন নিশ্চিত করা কোনো একজন শাসকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া এ অঞ্চলের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭ কোটি সাড়ে ১৮ লাখ। কাজেই প্রশাসনিক সুবিধার্থে বঙ্গভঙ্গ যৌক্তিকতা লাভ করে ।
(খ) আসাম প্রদেশের আয়তনের ক্ষুদ্রতা :
প্রতিবেশী প্রদেশ আসাম ছিল আয়তনে ক্ষুদ্র, যার শাসনব্যবস্থা ছিল নেহাত অপ্রতুল । সে কারণেই লর্ড কার্জন ১৯০২ সালের এপ্রিল মাসে ভারত সচিবকে প্রদেশের সীমানা ও প্রশাসনিক সংক্রান্ত সমস্যাবলি সম্পর্কে লিখেছিলেন । পরবর্তীতে বাংলাকে বিভক্ত করে ঢাকাকে রাজধানী করে রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ আসামকে নিয়ে পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠন করা হয় ।
২. অর্থনৈতিক কারণ :
বঙ্গভঙ্গের পশ্চাতে অর্থনৈতিক কারণসমূহ নিম্নরূপ :
(ক) পূর্ববাংলার অধিবাসীদের আবেদন :
পূর্ববাংলার জমিদাররা অধিকাংশই ছিল হিন্দু । তারা জমিদারি ত্যাগ করে কলকাতায় বসবাস করতো। যদিও পূর্ববাংলার জনগণ তাদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের অর্থের যোগান দিত, কিন্তু বিনিময়ে হিন্দু জমিদারগণ পূর্ববাংলার মুসলিম অধিবাসীদের কোনো কল্যাণই করতো না । ফলশ্রুতিতে পূর্ববাংলার বঞ্চিত মুসলমান অধিবাসীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বঙ্গভঙ্গের তাগিদ দেন ।
(খ) কলকাতার একচেটিয়া প্রাধান্য হ্রাস করা :
পূর্ববাংলার অধিবাসীগণ বিশেষত মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। এসব কিছুতে কলকাতার একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল। কাজেই বঙ্গভঙ্গের দ্বারা কলকাতার একচেটিয়া প্রাধান্য হ্রাস করে বাংলার মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করাই ছিল বঙ্গভঙ্গের অন্যতম লক্ষ্য ।
(গ) পূর্ববাংলার সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন :
তৎকালীন ভারত সরকার শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা ও সামগ্রিক উন্নয়নকার্যে সর্বদা পশ্চিম বঙ্গকেই বেশি প্রাধান্য দিত। পূর্ববাংলা ছিল উন্নয়নমূলক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত । কাজেই পূর্ববঙ্গকে পৃথক প্রদেশে পরিণত করে এর সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন করাই ছিল বঙ্গভঙ্গের অন্যতম লক্ষ্য ।
৩.রাজনৈতিক কারণ :
বঙ্গবঙ্গ করার জন্য নিম্নলিখিত রাজনৈতিক কারণও বিদ্যমান ছিল-
(ক) জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধ্বংস করে দেওয়া :
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বাংলা প্রেসিডেন্সির কেন্দ্র ছিল কলকাতা শহর । জাতীয়তাবাদী এ আন্দোলনকে নস্যাৎ এবং বিপ্লবীদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ করতে উদ্যোগী হয় ।
(খ) হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ সৃষ্টি :
হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধের বীজ বপন করে এদেশে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিকে শক্তিশালী করাই ছিল বঙ্গভঙ্গের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য।
(গ) পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের নবজাগ্রত চেতনা :
পূর্ব বঙ্গের জনগণের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই ছিলেন মুসলমান এবং তারা ছিলেন মূলত কৃষক। অপরপক্ষে অধিকাংশ জমিদার, বণিক, আইনজীবী ছিলেন হিন্দু । ব্রিটিশ শাসনের প্রথম থেকেই শোষক হিন্দু জমিদারগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুসলমান চাষিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম চালনা করে জীবনধারণ করতে হতো । ফলে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা গ্রহণ করলে পূর্ববঙ্গের কৃষক সমাজ এর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন ।
৪. ভৌগোলিক কারণ :
প্রায় দুই লাখ আয়তনবিশিষ্ট অবিভক্ত পূর্ববাংলা ছিল আয়তনের দিক দিয়ে উপমহাদেশের বৃহত্তম প্রদেশ । এ বিশাল প্রদেশের সুশাসন নিশ্চিত করা ভৌগোলিক দিক থেকে কোনো একজন প্রশাসকের পক্ষে দুষ্কর ছিল । ফলশ্রুতিতে ভৌগোলিক কারণে বঙ্গভঙ্গের প্রয়োজনীয়তা বাস্তবে রূপ নেয় ।
বঙ্গভঙ্গের প্রভাব বা ফলাফল : পরবর্তীকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলীর উপর বঙ্গভঙ্গের প্রভাব ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। নিম্নে বঙ্গভঙ্গের প্রভাব বা ফলাফল আলোচনা করা হলো :
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস pdf
১. পৃথক নির্বাচনের দাবি :
যে নির্বাচন ব্যবস্থা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিজ নিজ নির্ধারিত সংখ্যক প্রতিনিধি নির্বাচন করে তাই পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা নামে অভিহিত। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক মুসলমানদের বঙ্গভঙ্গের দাবি স্বীকৃতি লাভ করায় মুসলমানরা তাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে মুসলমান পক্ষ হতে পৃথক নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করেন । ১৯০৯ সালে মর্লি মিন্টো সংস্কার আইন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য প্রথম প্রতিনিধিত্বের নীতি প্রচলন করে মুসলমান সম্প্রদায়ের এ দাবিকে বাস্তবে রূপদান করে ।
২. মুসলমানদের অবস্থান সুসংহতকরণ :
মুসলমানরা ভারতের তৎকালীন মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি ছিল অর্থাৎ সাবেক রাশিয়াকে বাদ দিলে যেকোনো প্রথম শ্রেণীর ইউরোপীয় রাষ্ট্রের চেয়ে ভারতের মুসলমানদের সংখ্যা ছিল বেশি। যে কারণে মুসলমান প্রতিনিধিদল মুসলমান সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং দেশরক্ষায় তাদের আবেদনের যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের সাথে সাথে নিজেদের অবস্থানকেও সুসংহত করতে সচেষ্ট হন ।
৩. হিন্দু-মুসলমান ঐক্য :
বঙ্গভঙ্গ রদ এবং এর পরবর্তী ঘটনাবলী হিন্দু-মুসলমানদের একলা চলার নীতি পরিহারে অনুপ্রেরণা যোগায়। কারণ এ দুটি সম্প্রদায় উপলব্ধি করে যে, হিন্দু-মুসলমানদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কখনই ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসন হতে মুক্ত করা যাবে না। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক লক্ষ্মৌ চুক্তি। এ চুক্তি পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় গড়ে উঠা খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের শক্তি ও অনুপ্রেরণা যোগায় ।
৪. রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগের স্বীকৃতি লাভ :
বঙ্গভঙ্গের প্রভাবে ১৯১৬ সালে লক্ষ্মৌ চুক্তির ফলে মুসলিম লীগ তথা মুসলমান সমাজ সামগ্রিকভাবে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জাতীয় কংগ্রেসের সাথে একটা লাইনে দাঁড়ায় এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে উঠে । এছাড়া এই চুক্তির ফলে মুসলিম লীগ মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে ।
৫. ভারতীয় শাসন সংস্কার :
বঙ্গভঙ্গের প্রভাবেই ব্রিটিশ সরকারকে ভারত সংক্রান্ত নীতির পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য করে । ১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইন এবং ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন ছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফসল, যা পরবর্তীকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলীর উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল ।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ ছিল একটি সুদূরপ্রসারী আন্দোলন । এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাবলীতে নতুনতর গতি সঞ্চারিত হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে মুসলমানগণ বুঝতে পারল ভবিষ্যত আর ইংরেজদের বিশ্বাস করা যাবে না এবং বিশ্বাস আলোচনা বা সহযোগিতার মাধ্যমে নয়, বরং আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমেই দাবি আদায় করতে হবে। মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাস ভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য এবং ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে ছিন্ন করার সকল আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় আন্দোলন ছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ।