পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ভূগোল :
পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে ভূগোলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। পৌরনীতি নাগরিকতাবিষয়ক সামাজিক বিজ্ঞান।
নাগরিক জীবনের সব বিষয় তা সামাজিক, রাজনৈতিক বা অন্য ধরনের যা-ই হোক না কেন পৌরনীতি আলোচনা করে। তেমনি ভূগোল সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম একটি শাখা;
যেখানে ভৌগোলিক সীমানা দ্বারা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় কার্যাবলির বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় এবং রাষ্ট্রের সব স্থানের পূর্ণাঙ্গ ধারণার মাধ্যমে পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহের প্রয়োজনীয় কার্যাবলি ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।
পৃথিবীর সব স্থানের রাজনৈতিক পরিবেশ, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সামাজিক পরিবেশ এক রকম নয়।
স্থানভেদে বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনীতি, জাতির মানসিকতা, আচার-আচরণ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ের ভিন্নতা দেখা যায়।
এক্ষেত্রে ভৌগোলিক অনুষঙ্গটি প্রধান বলা যায়। এখানে পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে ভূগোলের সম্পর্ক আলোচনা করা হলো-
১। উভয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ : নাগরিক ও তার জীবনঘনিষ্ঠ সব বিষয় পর্যালোচনা করাই হলো পৌরনীতি ও সুশাসনের উদ্দেশ্য।
অপরদিকে ভূপ্রকৃতিগত বিষয় এবং পারিপার্শ্বিক বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করা হলো ভূগোলের আলোচ্য বিষয়।
রাষ্ট্র গঠিত হতে হলে যে কয়টি উপাদান প্রয়োজন, তার মধ্যে ভূখণ্ড অন্যতম। কেননা রাষ্ট্রের স্থিতি, উন্নতি, সংহতি প্রভৃতি নির্ভর করে ভূকেন্দ্রিক রাজনীতির উপর।
রাজনৈতিক বিষয়াদির উপর ভৌগোলিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে তা গবেষকরা মেনে নিয়েছেন।
ফরাসি দার্শনিক বোদিন (Bodin) রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ভূগোলের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন।
ফরাসি অপর দার্শনিক মন্টেস্কু (Montesquieu) বলেন, “ভৌগোলিক পরিবেশের দ্বারাই দেশবাসীর স্বাধীনতার বাসনা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।”
বাকল্ (Buckle) মত দেন, “ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত অবস্থার উপর সমাজবদ্ধ মানুষের প্রকৃতি বিশেষভাবে নির্ভরশীল।”
এদিক থেকে বলা যায়, পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ভূগোলের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান।
২। ভূকেন্দ্রিক রাজনীতি : ব্যক্তির চরিত্র এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারের উপর জলবায়ু ও ভৌগোলিক উপাদানসমূহ প্রভাব বিস্তার করে।
ভূকেন্দ্রিক উপাদানসমূহ রাজনৈতিক কার্যাবলি ও জাতীয় নীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে ।
৩। পৌরনীতি ও সুশাসনের বিষয় ভৌগোলিক অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত : ভূগোলের ভূমি অংশের সাথে পৌরনীতি ও সুশাসনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও আর্থিক সম্পদ,
নগরের উৎপত্তি ও বিকাশের কারণ, রাষ্ট্রের আয়তন, কৃষিসম্পদ, খনিজ দ্রব্য ইত্যাদি ভূগোলের সামাজিক অংশ পৌরনীতির দ্বারা প্রভাবিত।
ভৌগোলিক দূরত্ব ও নৈকট্য রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ভূগোলের সামাজিক উপাদানগুলো রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে জড়িত।
লর্ড ব্রাইস (Bryce) বলেন, “In a country, physical conditions and inherited institutions so affect than political institutions of a nation as to give its government a distinctive character.”
৪। জাতীয় নীতিনির্ধারণে সম্পর্ক : কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় নীতিনির্ধারণে ভৌগোলিক পরিবেশের ভূমিকা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
ভৌগোলিক পরিবেশ জাতীয় নীতিনির্ধারণে যেমন ভূমিকা রাখে, তেমনি পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণেও ভৌগোলিক উপাদান কম প্রয়োজনীয় নয়।
অ্যারিস্টটল, বোদিন, রুশো প্রমুখ দার্শনিক ভৌগোলিক অবস্থাকে জাতীয় নীতিনির্ধারণের অন্যতম উপাদান বলে স্বীকার করেছেন।
একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে স্বার্থগত দ্বন্দ্ব বিরাজ করে। এসব স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বা জাতীয় নীতিগত বিষয়গুলো ভৌগোলিক পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
পরিশেষে বলা যায়, ভৌগোলিক উপাদানের সাথে রাষ্ট্রের অবস্থান, সরকার কাঠামো, সাফল্য এবং নাগরিক চরিত্র জড়িত বলে পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ভূগোলের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
উভয় শাস্ত্র নানা ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল। মেরিয়াম ও বার্নেস (Marium & Burness) বলেন, “নাগরিকদের পরস্পরবিরোধী স্বার্থের সমন্বয়সাধক ও নিয়ন্ত্রক হলো রাষ্ট্র;
ভৌগোলিক পরিবেশের উপর যেসব স্বার্থের প্রকৃতি, তাদের শক্তি এবং সংগ্রামের গভীরতা অনেকাংশে নির্ভরশীল।”
সুতরাং, সামাজিক বিজ্ঞানের ধারা হিসেবে প্রকৃতপক্ষে উন্নত, সমৃদ্ধিশালী, কল্যাণমুখী নাগরিক ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ভূগোলের পরস্পর পথচলা।
এজন্য এদের মধ্যে সম্পর্কও গভীর