[] পাঠ-১.৩ : পৌরনীতি ও সুশাসনের ক্রমবিকাশ
Evolution of Civics and Good Governance
পৌরনীতির ক্রমবিকাশ : পৌরনীতি নাগরিকতাবিষয়ক সামাজিক বিজ্ঞান।
এটি সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনৈতিক কার্যাবলি বিশ্লেষণ করে। পৌরনীতির আলোচনা থেকে জানা যায়, প্রাচীন গ্রিসে এর উৎপত্তি।
প্রাচীন গ্রিসে প্রথমে নগররাষ্ট্রের ধারণা বিস্তৃতি লাভ করে। গ্রিসে প্রথমে নগর ও নাগরিককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন ঘটে।
সমাজবন্ধ মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ ও সুন্দর করার প্রয়াসে নগররাষ্ট্র গড়ে ওঠে।
পৌরনীতি শব্দটি এসেছে ইংরেজি Civics শব্দ থেকে, যা ল্যাটিন শব্দদ্বয় Civis ও Civitas থেকে উদ্ভূত; যার অর্থ হলো ‘নাগরিক’ ও ‘নগররাষ্ট্র’।
গ্রিসে জীবনযাত্রা কেন্দ্রীভূত ছিল ছোট ছোট নগররাষ্ট্রের মধ্যে। নাগরিকগণ কিছু বিধিবিধান ও নিয়মকানুনের মাধ্যমে পরিচালিত হতো।
আর রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল প্রত্যক্ষ। কেননা রাষ্ট্রের পরিধি ছিল খুব ছোট এবং জনসংখ্যা ছিল নগণ্য। ফলে সবাই সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারত।
তাছাড়া শুধু সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত জনসাধারণকে নাগরিকের মর্যাদা দান করা হতো।
নাগরিকের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা ও মর্যাদা দান করেন প্লেটো। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তাঁর বিখ্যাত রচনা The Republic’ গ্রন্থে নাগরিকের সংজ্ঞা ও রাষ্ট্রে তাদের শ্রেণিবিন্যাস করেন ।
কেননা তিনি যে আদর্শ রাষ্ট্র কল্পনা করেন সেখানে রাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বতন্ত্র অবস্থান তুলে ধরেন।
তবে তৎপরবর্তী প্লেটোর যোগ্য শিষ্য অ্যারিস্টটল তাঁর বিখ্যাত রচনা The Politics’-গ্রন্থে বাস্তবতার নিরিখে নাগরিক, রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেন।
তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রের উৎপত্তির পেছনে রয়েছে নাগরিকের কল্যাণসাধন ও প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করা।
অ্যারিস্টটল রাষ্ট্র ও নাগরিক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে পূর্ণাঙ্গ শ্রেণিবিন্যাস এবং মর্যাদা দিয়েছিলেন।
এজন্য তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান তথা পৌরনীতির জনক হিসেবে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে রোমান চিন্তাবিদগণ নাগরিক ও রাষ্ট্রকে বৈধতা দান করেন।
এখানে নাগরিককে রাষ্ট্রের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত করা হয়। এ পর্যায়ে নাগরিককে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ ও সুবিধা প্রদানে রাষ্ট্রের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পাশাপাশি নাগরিক তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করে। পলিবিয়াস, সিসেরো প্রমুখ রোমান দার্শনিক পৌরনীতিকে নাগরিক,
নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য এবং রাষ্ট্রের ধারণার আলোকে ব্যাখ্যা করেন, যা সে সময়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। প্রাচীন গ্রিস ও রোমান চিন্তাবিদদের হাতে রাষ্ট্র একটি সাধারণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এরপর আসে মধ্যযুগে রাষ্ট্র ও নাগরিক সম্পর্কিত চিন্তাধারা। এ সময়ের প্রখ্যাত দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট টমাস একুইনাস, মারসিলিও পাদুয়ার প্রমুখ রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণার তেমন উন্নতি সাধন করতে পারেননি।
যদিও তৎপূর্বেই রাষ্ট্র ও নাগরিক এবং রাষ্ট্রে নাগরিকের অবস্থান মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত।
পৌরনীতি
তবে রাষ্ট্র, রাজনীতি, শাসক ও জনগণ যে একই সত্তা তার প্রমাণ আমরা পাই ইতালির প্রখ্যাত দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির (Niccolo Machiavelli) আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ধারণা থেকে।
তিনি তাঁর বিখ্যাত The Prince গ্রন্থের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বাস্তবতার ভিত্তিতে বিবেচনা করেন এবং রাজনীতিতে নৈতিকতার স্থান নির্দিষ্ট করে।
দেন। আধুনিক যুগে এসে পৌরনীতি ধারণাটি বিকাশ লাভ করে।
গ্রিস ও এথেন্সে যারা রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেত তারাই প্রকৃতপক্ষে নাগরিকের মর্যাদা পেত।
অন্যান্য অংশের অধিবাসীদের নাগরিক মর্যাদা প্রদান করা হতো না। আবার আধুনিককালে জ্যা জ্যাক রুশো, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ দার্শনিক নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার অবতারণা করেন,
যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে সঠিক ও সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে হবে।
পৌরনীতির ধারণাটি খুব বেশি পুরাতন নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আমেরিকায় পাঠ্যবই হিসেবে শ্রেণিকক্ষে পৌরনীতি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়।
এ সময় রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করণের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের কথা বলেন।
পরবর্তীকালে রাষ্ট্রে নাগরিকদের উন্নতভাবে গড়ে তোলার মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম নেওয়া হয়।
অর্থাৎ, উত্তম নাগরিক ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পৌরনীতি বিষয়টির অবতারণা করা হয়।
সুশাসনের ক্রমবিকাশ : সুশাসন (Good governance) প্রত্যয়টি বর্তমানে উন্নত বিশ্বে বহুল প্রচলিত একটি ধারণা। তবে সুশাসন প্রত্যয়টি বর্তমানে ব্যবহৃত হলেও প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তাবিদ অ্যারিস্টটলের লেখার মধ্যে আমরা এর ধারণা পাই।
তিনি সুশাসনের মাধ্যমে নাগরিকদের উন্নত জীবনের নিশ্চয়তার কথা বলেছেন। অ্যারিস্টটল তাঁর The Politics’-এ বলেন, সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে জনকল্যাণের জন্য।
এজন্য তিনি শাসকের কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেছেন। এতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন,
যদি শাসক রাষ্ট্রে নিজের ভালোমন্দ আগে ভাবে এবং নাগরিক কল্যাণে অবদান না রাখে তাহলে সেই সরকার গ্রহণযোগ্য নয়।
আবার শাসক যদি জনকল্যাণে কাজ করে তাহলে তার স্থিতিশীলতা বিরাজ করে। অর্থাৎ এখানে সুশাসনের বিষয়টি চলে আসে।
এখানে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য তা হলো, জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে জবাবদিহিমূলক সরকারব্যবস্থাই হলো সুশাসনের মূল বিষয়।
তবে বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সুশাসন প্রত্যয়টি বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। কেননা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দাতাগোষ্ঠী প্রচুর অর্থ লগ্নি করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য।
তাদের দেওয়া প্রেসক্রিপশন অনুসারে এসব দেশের সরকারগুলোকে প্রতিনিয়ত তাদের নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হয়।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বব্যাংক এগিয়ে আসে।
তারা ওই সব দেশে সুশাসনের ধারণা দেয় এবং কিছু শর্ত আরোপ করে। সে সময় বিশ্বব্যাংক আফ্রিকা অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে Long Term Perspective Study on Sub Saharan Africa (LPTS) প্রতিবেদন প্রকাশ করে;
যাতে তারা দেখাতে চায়, এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি কম হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো সুশাসনের অভাব।
ফলে তখন থেকে তাদের নির্দেশিত কিছু প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে সরকারগুলোকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়।
এভাবে সুশাসন ধারণাটি বিকাশ লাভ করে। অবশ্য বিশ্বব্যাংক কয়েকটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেয় সুশাসন সম্পর্কিত বিষয়ে।
কোনো দেশের জনসাধারণ ও সরকারের দিক থেকে যে বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা চাওয়া হয় তা হলো বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা ও জবাবদিহি থাকবে, স্থিতিশীল রাজনীতি হবে,
সহিংস রাজনীতি বন্ধ হবে, সরকারের কার্যকর উপস্থিতি, সরকার ও প্রশাসনে মানসম্মত সেবাদান, সব ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমিয়ে আনা হবে।
এভাবে নানামুখী নির্দেশনার মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। তবে একথা বলা যায়, রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুশাসন প্রত্যয়টি খুব বেশি নতুন নয় এবং হঠাৎ করে এটি আবির্ভূত হয়নি।
শাসনসংক্রান্ত চিন্তাচেতনার মিথস্ক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে নানামুখী বিবর্তনের মাধ্যমে সুশাসন প্রত্যয়টি পৌরনীতির সাথে যুক্ত হয়েছে।
সুতরাং পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়টি বর্তমানে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত।