১১ প্রশ্ন: ৩.৭। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য আলোচনা কর। অথবা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য

উত্তর : ভূমিকা : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় । তবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও পূর্ববাংলার মানুষের স্বাধীনতা আসে নি । পাকিস্তানের মূল ক্ষমতায় থেকে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা । অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান চরম বৈষম্যের শিকার হয়। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেয় নি ।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য : নিমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য উল্লেখ করা হলো : 

১. রাজস্ব আয় ও ব্যয়ে বৈষম্য : 

সরকারি রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় । নিয়ে ছকের সাহায্যে উভয় অঞ্চলের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখানো হলো : (১৯৬৫-১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮-১৯৬৯ সাল কোটি টাকায়)

খাতপূর্ব পাকিস্তানপশ্চিম পাকিস্তান
আয়৭২৮১৭৮১.৭
ব্যয়১৩৩৬.২২৭৬৭.১
 ঘাটতি৬০৭.৭৯৮৫.৪
ঘাটতি পূরণ৬০৬.৭৯৮৫.৪
উৎস : Rehman Sobhan, “The balance Sheet of Disparity”, The Forum, 1970.

মাথাপিছু আয় ও জীবনমান বৈষম্য :

পাকিস্তান শাসনামলে মাথাপিছু আয় হ্রাসের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জীবনযাত্রার নিম্নমান বজায় থাকে, যা ছিল তাদের জন্য চরম অপমান ও অসম্মানজনক ।

ঋণ বরাদ্দে বৈষম্য :

ঋণ বিতরণকারী সংস্থাসমূহ বিশেষত পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক, পাকিস্তান শিল্প ঋণ ও বিনিয়োগ কর্পোরেশন, হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ এরূপ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বরাদ্দে বৈষম্য করে ।

পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসমূহে বৈষম্য :

১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে পাকিস্তানে ২টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও উভয় অঞ্চলের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। একনজরে ২য় ও ৩য় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মোট বরাদ্দ ছকে দেখানো হলো (মিলিয়ন রুপি) :

২য় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৬০-১৯৬৫)

খাতপূর্ব পাকিস্তানপশ্চিম পাকিস্তান
সরকারি খাত৬৭০০১০৮০০
বেসরকারি খাত৩০০০১০৭০০
মোট৯৭০০২১৫০০
মোট ব্যয়ের হার৩১%৬৯%

৩য় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৬৫-১৯৭০)

খাতপূর্ব পাকিস্তানপশ্চিম পাকিস্তান
সরকারি খাত১১৩০০১৩৭০০
বেসরকারি খাত৫৬০০১৬০০০
মোট১৬৯০০২৯৭০০
মোট ব্যয়ের হার৩৬%৬৪%
আমদানি-রপ্তানি বৈষম্য :

পাকিস্তানের বহির্বাণিজ্য তথা আমুদানি-রপ্তানি সম্পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল। এটি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পরিচালিত হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান চরম বৈষম্যের শিকার হয় ।

কৃষি উন্নয়নে বৈষম্য :

১৯৪৭-১৯৪৮ সালে বিশ্বের মোট ৮১% পাট উৎপাদনের গর্বিত দাবিদার পূর্ব পাকিস্তান। অথচ কৃষি উন্নয়নে সরকারের অবহেলার কারণে ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় মাত্র ৩৫ শতাংশে ।

অবকাঠামোগত বৈষম্য :

১৯৭০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫৫০ হাজার কিলোওয়াট। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১৯৫৬ হাজার কিলোওয়াট । বার্ষিক মাথাপিছু বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহারে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ১৩ কিলোওয়াট ঘণ্টা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯২ কিলোওয়াট ঘণ্টা । ফলে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া সেনা ও নৌবাহিনীর সদরদপ্তর এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপন করা হয় ।

আঞ্চলিক বিনিয়োগে বৈষম্য :

১৯৫০ এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মোট বিনিয়োগের ২১% থেকে ২৬%। ১৯৬০ এর দশকে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩২% থেকে ৩৬%। অপরদিকে রাজস্ব ও উন্নয়নখাত মিলে পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগ করা হয় প্রথম দশকে ৭৪% থেকে ৭৯% এবং দ্বিতীয় দশকে ৬৪% থেকে ৬৮%।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ :

এক দশকেরও অধিককাল ধরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা এবং সঠিক সেচ পদ্ধতির জন্য অভিযোগ করে আসছিল । ১৯৫৪ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময় পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা দেখা দেয় এবং তা বিশ্ব সংবাদে পরিণত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণে তেমন কিছুই করে নি ।

হস্তশিল্পের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা :

দেশ বিভাগের সময় বাংলার তাঁতশিল্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৯৪৭ সালে এখানে হস্তচালিত তাঁতশিল্প ছিল ২৫০ হাজার। ১৯৫১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৮৩ হাজারে। এখানকার হস্তশিল্পগুলো তুলা ও সুতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, পাক শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থান্বেষী অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ পশ্চিম পাকিস্তানে বিশেষ আর্থিক সুবিধা সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক সকল পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রণীত হতো। এতে পূর্ব পাকিস্তানিরা বৈষম্যের শিকার হতো । বৈষম্যনীতির কারণে তারা অবহেলিত ও উপেক্ষিত হয়। অন্যদিকে পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রভূত উন্নতি হয় ।

বাংলাদেশের অভ্যুদয় এর প্রেক্ষাপট: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related