জাতীয়তার উপাদানসমূহ
Elements of Nationality
যেসব উপাদান একটি জনসমাজকে জাতীয় জনসমাজে রূপান্তরিত করে সেসব উপাদানকে জাতীয়তার উপাদান বলা হয়।
আর এ উপাদানগুলো জাতীয় জনসমাজকে জাতি গঠনে সহায়তা করে। যেকোনো সমাজে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে দ্বিবিধ উপাদানের সংমিশ্রণে।
যেমন- বাহ্যিক উপাদান ও ভাবগত উপাদান। জাতীয়তার উপাদানগুলো
এখানে আলোচনা করা হলো-
১। ভৌগোলিক ঐক্য (Geographical Unity) : বসবাসের ক্ষেত্রে ভূখণ্ডগত সংলগ্নতা বা একই ভৌগোলিক বেষ্টনীর বাসিন্দা হওয়া মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা, সহমর্মিতা, ভালোবাসা ইত্যাদির মতো মানবিক অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।
এসব উপাদান জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে জোরদার প্রভাব ফেলতে সমর্থ। একই ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগণের মধ্যে সহযোগিতা, ভালোবাসা ও নিরাপত্তাবোধ গড়ে ওঠে।
প্রয়োজনীয় লেনদেন, বিনিময় ইত্যাদি করতে পারে এবং এর ফলে এমন নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয় যে, বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা তারা ভাবতেই পারে না।
এজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ভৌগোলিক ঐক্যকে জাতীয়তা গঠনের অন্যতম উপাদান হিসেবে গণ্য করেছেন।
জাতীয়তার অন্যান্য উপাদান থাকা সত্ত্বেও শুধু ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতাই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ভেঙে দেয় এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
তবে ভৌগোলিক ঐক্য না থাকলেও যে জাতি গঠন হতে পারে তার বড় প্রমাণ ইহুদিরা।
প্যালেস্টাইনে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও জাতীয়তাবোধের কোনো কমতি ছিল না।
২। বংশগত ঐক্য (Racical Unity) : জাতীয়তার অন্যতম উপাদান হলো বংশগত ঐক্য।
এর প্রধান অনুষঙ্গ হলো রক্তের বন্ধন। এ জন্য রক্তের টান কথাটির তাৎপর্য অনেক। কোনো জনসমাজ যখন বিশ্বাস করে যে, তাদের শিরা- উপশিরায় একই রক্ত প্রবাহিত এবং তাদের আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অভিন্ন, তখন স্বভাবতই তাদের মধ্যে স্বজনপ্রীতি দেখা দেয় ।
এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে জন্মসূত্রে যে সম্পর্ক তা দিয়েই রচিত হয় বংশগত ঐক্যের ধারা। এ ঐক্য সুদৃঢ় হওয়ার কারণে রক্ত-সম্পর্ক জাতি গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অবশ্য বর্তমানে জাতি গঠনের উপাদান হিসেবে বংশগত অভিন্নতাকে বিশেষ মূল্য দেওয়া হয় না। বিভিন্ন বংশোদ্ভূত জনগণকে নিয়েই আধুনিক যুগের অনেক শ্রেষ্ঠ জাতি গঠিত হয়েছে।
যেমন— ইংরেজ, হল্যান্ড, জার্মান ইত্যাদি। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহু বংশের লোকের বসবাস সত্ত্বেও তারা একই জাতীয়তাবোধ উদ্বুদ্ধ।
পাশাপাশি আরবের লোকেরা একই কুল থেকে উদ্ভূত হয়েও কেউ সাউদি, কেউ মিশরি, কেউ লিবীয়, কেউ সিরীয় ।
৩। ধর্মীয় ঐক্য (Religious Unity) : একটি জনসমাজের আচার-ব্যবহার, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ প্রভৃতির সবকিছুতেই ধর্ম প্রভাব বিস্তার করে।
এই ধর্মীয় অনুভূতি যদি প্রবল হয় তাহলে সেই জনসম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য সহজেই গড়ে ওঠে এবং তা সংরক্ষণে কমবেশি সবাই যত্নবান হয়। কারণ তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি অভিন্ন।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাজনীতি বিশ্লেষণ করে ধর্মের প্রাধান্য পাওয়া যায়। তবে ধর্মই জাতীয়তার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিষয় নয়।
কেননা, পাকিস্তানের উভয় অংশের অধিবাসীরা ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে স্বাধীনতা লাভ করলেও জাতীয়তার অন্য উপাদানগুলোর অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হয়।
৪। ভাষাগত ঐক্য (Unity in Language) : ভাষা ও সাহিত্যগত ঐক্য জাতীয়তা গঠনে অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
ভাবের আদান-প্রদান দিয়ে মানবসমাজের সদস্যদের মধ্যে প্রথম যোগাযোগ শুরু হয়। এর পথ ধরেই অন্যান্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
কারণ মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা। ভাষার মাধ্যমে একজন অন্যজনকে সহজে বুঝতে পারে। একে অন্যের চাহিদা ও স্বার্থ সম্বন্ধে সহজে জানতে পারে এবং তা মেটাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।
একই ভাষাভাষী জনসাধারণ তাদের নিজেদের ভাব-চিন্তা-চেতনা ইত্যাদির সাদৃশ্যের কারণে নিজেদের অন্য জাতি থেকে পৃথক মনে করে।
ফলে অতি সহজেই তাদের মধ্যে ঐক্যবোধ, একাত্মবোধ তথা জাতীয়তার সৃষ্টি হয়। ভাষাগত ঐক্যের অন্যতম উদাহরণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের সূতিকাগার। ভাষাগত ঐক্যের কারণেই বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করেনি।
যার ফলে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা আন্দোলন সংঘটিত হয় এবং বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করে। অধ্যাপক গার্নার বলেন,
“Community of language is the most important factor in moulding a people into a nationality.”
অর্থাৎ, ভাষাগত ঐক্যের বন্ধন জাতীয়তার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৫। ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উপাদান (Tradition and Culture) : প্রচলিত রীতিনীতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ঐক্য জাতি গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
দীর্ঘদিন একটি ভূখণ্ডে বসবাস করলে জনসমাজের মধ্যে ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে সমন্বয়সাধনের ফলে ঐতিহ্যগত ঐক্য গড়ে ওঠে।
দীর্ঘদিন একত্রে বসবাসের ফলে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া এবং অন্য জনগোষ্ঠীর সাথে আদান-প্রদান, বন্ধুত্ব-বৈরিতা, যুদ্ধবিগ্রহ, টানাপড়েন প্রভৃতিকে সাহস ও শৌর্যের সাথে মোকাবিলা করার মাধ্যমে এটি গড়ে ওঠে।
পূর্বসূরিদের এসব অতীত কার্যকলাপ পরবর্তীদের প্রেরণা ও গৌরববোধের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। তাদের আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি ইত্যাদি অন্যদের চেয়ে পৃথক ভাবতে তদেরকে অনুপ্রাণিত করে।
রামজে ম্যুর ও জন স্টুয়ার্ট মিল তাই ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্যবোধকে জাতীয়তার অতি প্রয়োজনীয় উপাদান বলে বিবেচনা করেছেন।
৬। অর্থনৈতিক স্বার্থ (Economic Interest) : একটি জনসমাজের ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে অন্যান্য উপাদানের চেয়ে অর্থনৈতিক উপাদান অধিকতর বাস্তব।
মার্কসবাদীরা বলেন, “সমান অর্থনৈতিক স্বার্থ ভাষাগত বা ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাকে অস্বীকার করে কোনো জনসমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে।”
অর্থনৈতিক বঞ্চনা, শোষণ ও বৈষম্য জাতীয় জনসমাজকে অধিকার আদায়ের ও আত্মনির্ভর হওয়ার প্রেরণা জোগায়। মানুষ সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের আন্দোলনে লিপ্ত হয় এবং সাম্যভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজে বসবাসে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
পাকিস্তানি শাসকদের একচেটিয়া শোষণ এবং দেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্যজনিত দুর্দশা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল। অর্থনৈতিক স্বার্থ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কার্যকর হাতিয়ার।
৭ । স্বার্থগত ঐক্য (Unity in Interest) : একই স্বার্থ যেমন- অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও কৃষ্টি কোনো দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করার প্রেরণা দেয়।
জনগণের স্বার্থ যদি অভিন্ন হয় তবে তারা একত্রে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। তারা নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করে এবং নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। তবে জাতীয়তার জন্য এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নয় ।
৮। রাজনৈতিক চেতনা (Political Consciousness) : জাতীয়তা গঠনে ও বিকাশে অন্যান্য উপাদানের সাথে রাজনৈতিক চেতনাও বিশেষ ভূমিকা রাখে।
অন্য উপাদানগুলো জনগণের অন্তরে বদ্ধমূল করে তাদের মধ্যে প্রেরণা ও নিজেদের মতো বাঁচার স্বপ্ন রাজনৈতিক চেতনার মাধ্যমে বাস্তবে রূপলাভ করে।
রাজনৈতিক চেতনা না থাকলে ভৌগোলিক অখণ্ডতা, ধর্মীয় বা বংশগত ঐক্য, অর্থনৈতিক স্বার্থ বা ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত উপাদানসমূহকে জনমনে বদ্ধমূল করার কোনো উপায় বা পথ থাকে না।
৯। ভাবগত ঐক্য (Spiritual Unity) : ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Renan-এর মতে, “জাতীয় জনসমাজ সম্পর্কে ধারণা মূলত ভাবগত।”
জনসমাজের মধ্যে মনোগত একাত্মবোধের অস্তিত্ব জাতীয়তার অপরিহার্য উপাদান। বিভিন্নমুখী ও বিভিন্নমাত্রিক বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও মানসিকভাবে ঐসব জনসমাজ একত্রে ও ঐক্যবদ্ধভাবে জীবনযাপনে অভিলাষী।
তারা বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের প্রতিষ্ঠা দেখতে চায়। এটাই তাদের জাতীয়তা নির্মাণের প্রধান হাতিয়ার।
কানাডার জনগণের মধ্যে ভাষা ও বর্ণের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ভাবগত ঐক্যের কারণে তারা ঐক্যবদ্ধ হয় ।
১০। একই আশা-আকাঙ্ক্ষা (Common Aspirations) : জাতীয়তার আরেকটি উপাদান হলো একই আশা- আকাঙ্ক্ষা। এটি একই বংশ, ভাষা, ধর্ম এবং ঐতিহাসিক উপাদানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
এশিয়া, আফ্রিকার অনেক জাতি এই উপাদানের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছে। রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারিত হলে কোনো জাতি পূর্ণাঙ্গ জাতিতে পরিণত হয়।
১১। মনোগত উপাদান (Mental Elements) : প্রকৃতপক্ষে একত্রে বাস করার আন্তরিক ইচ্ছা না থাকলে অভিন্ন ভাষা, ধর্ম, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইত্যাদির কোনোটিই মানবসমাজকে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে না।
অধ্যাপক স্পেংলার বলেন, জাতীয়তার উপাদান কুলগত বা ভাষাগত ঐক্য নয় বরং মনোগত ঐক্য। অধ্যাপক লাস্কি তাই মত দেন, জাতীয়তার ধারণা এক প্রকার মানসিক ধারণা।
উপরের আলোচনা শেষে বলা যায়, জাতীয়তা গঠনে কোনো একক উপাদানের গুরুত্ব যেমন বেশি নয়, তেমনি নানামুখী টানাপড়েনের মাধ্যমে গঠিত অন্য সব উপাদান একে করেছে শক্তিশালী।
যার ফলে জাতীয়তা তার নিজস্ব রূপ পেয়েছে। তবে একথা বলা যায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদে ধন্য ও অভিশাপে জর্জর বর্তমান বিশ্বমানবতার প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবনে যে জটিলতা, সমস্যা ও
বিচিত্রমুখী সম্পর্কের টানাপড়েন, তাতে ভাবগত ঐক্য না থাকলে কোনো উপায়েই অন্যান্য উপাদানের সক্রিয়তায় জাতীয়তার অবিনাশী ভাবধারা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।