৫.৫। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর। অথবা, ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের উপর একটি প্রবন্ধ লিখ।

১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের উপর একটি প্রবন্ধ

ভূমিকা:

১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের নামে যে চমক দেখান, ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ ছিল তার মধ্যে অন্যতম। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজের স্বার্থ বিরোধী হওয়ায় এর বিরুদ্ধে গড়ে উঠা বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে শিক্ষা কমিশন’ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে এবং পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র আন্দোলনের ধারায় সম্পৃক্ত হয়ে তা ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলনে পর্যবসিত হয়।

শিক্ষা কমিশন গঠন : জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তগত করে এবং সামরিক
আইন জারি করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের নামে যে চমক দেখান, শিক্ষা সংস্কারের চেষ্টা ছিল তার একটি। আইয়ুব খান
১৯৫৮ সালের ১২ ডিসেম্বর শিক্ষা কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে
.শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো। সরকারিভাবে শিক্ষা কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয় ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর।
তদানীন্তন শিক্ষা সচিব এস. এম. শরীফকে সভাপতি করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়।
সভাপতির নামানুসারে শিক্ষা কমিশনটি ‘শরীফ কমিশন’ নামে অভিহিত। তবে কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশকালে শিক্ষা
সচিব ছিলেন হামিদুর রহমান। এ কারণে পূর্বে গঠিত ‘শরীফ কমিশন’টি পরবর্তীতে ‘হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন’
নামে পরিচিতি লাভ করে।


শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট :
১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট শরীফ কমিশনের রিপোর্ট সুপারিশ আকারে পেশ করা
হয়। কিন্তু রিপোর্টটি মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। শিক্ষা কমিশন শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করে যেসব সুপারিশ
পেশ করে সেগুলো ছিল নিম্নরূপ :


১. দুই বছরের বি. এ. পাস কোর্স পদ্ধতির পরিবর্তে তিন বছরের বি.এ. পাস কোর্স পদ্ধতি চালু করা
২. প্রাদেশিক পর্যায়ে স্কুল-কলেজের সংখ্যা সীমিত রাখা।
৩. শিক্ষা ব্যয়ের শতকরা ৮০ ভাগ অভিভাবক এবং বাকি ২০ ভাগ সরকার কর্তৃক বহন করা।
৪. ৬ষ্ঠ শ্রেণী হতে ডিগ্রি স্তর পর্যন্ত ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা।

শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন :
১৯৬২ সালের প্রথমার্ধে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টটি মুদ্রিত
হয়ে প্রকাশিত হলে এর বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ যে ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলনের সূত্রপাত করে তা ইতিহাসে ‘বাষট্টির
শিক্ষা আন্দোলন’ নামে খ্যাত। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি করাচিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতারের
প্রতিবাদে এবং ১৯৬২ সালের ১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ-বিরোধী পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংবিধান ঘোষণার পর থেকে এ
সংবিধানের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক যে আন্দোলন গড়ে তোলে, ছাত্রসমাজের স্বার্থ
বিরোধী শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট তাতে নতুন মাত্রা ও নতুন গতি সঞ্চার করে।

শুধুমাত্র তিন বছরে বি. এ. পাস কোর্স পদ্ধতি চালুর বিষয়টিকে বাদ দিলে শিক্ষা কমিশনের অন্যান্য সুপারিশসমূহ ছিল।
প্রকাশিত হবার সাথে সাথে পূর্ববাংলার সচেতন ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু করে এবং অচিরেই
সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজের স্বার্থবিরোধী। যার ফলে রিপোর্টটি মুদ্রিত হয়ে
পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজের স্বার্থ বিরোধী শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবি জানায়। এ দাবি আন্দোলন শেষ পর্যন্ত
ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলনে পরিণতি লাভ করে। এ আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ছিল নিম্নরূপ :


(ক) বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা : ১৯৬২ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম ঢাকা কলেজের ছাত্ররা
বিক্ষোভ করে। তারা ‘ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ আন্দোলনকে
গতিশীল করার চেষ্টা করে। এ ফোরামের ব্যানারে ছাত্রনেতৃবৃন্দ ঢাকা শহরের অন্যান্য কলেজেও (জগন্নাথ কলেজ, কায়েদে
আযম কলেজ, ইডেন কলেজ প্রভৃতি) প্রতিবাদ সভা করে। ঢাকা কলেজের ছাত্রদের গড়ে তোলা আন্দোলনে শ্রাঘ্রহ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতৃবৃন্দ জড়িয়ে পড়েন এবং ‘ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম’ শেষ পর্যন্ত ‘ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফোরামে
যাওয়া আন্দোলনের গতি-প্রকৃতিতেও পরিবর্তন সূচিত হয়।


(খ) সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল : ১৯৬২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন ছাত্রলীগ ও
ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত হতে থাকে। ১৫ আগস্ট, ১৯৬২ সালে প্রদেশ ব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের
আহ্বানের পাশাপাশি ১৫ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন মিছিল-বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা
আহ্বান করে হরতাল। বিক্ষুব্ধ ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে পড়ে এবং
শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের জন্য ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলে। আন্দোলন দমন করার জন্য শাসকগোষ্ঠীর
লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে নিহত হয় বাবুল, বাসকন্টাক্টর গোলাম মোস্তফা এবং গৃহভৃত্য ওয়াজিউল্লাহ এবং ছাত্র-
জনতা সহ প্রায় আড়াইশো জন আহত হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর একজন আহত ছাত্র নিহত হয়। শুধুমাত্র ঢাকাতেই নয়, ১৭
সেপ্টেম্বর যশোর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী প্রভৃতি জেলা শহরেও ব্যাপক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। এ
আন্দোলনের ফলে সরকার শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ স্থগিত করে।


৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের ফলাফল : ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের ফলাফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী । প্রকাশ্য
রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাত্র আন্দোলনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ না করলেও ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন সফল হয়। এ আন্দোলনের সাফল্যের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিম্নরূপ :
১. শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট স্থগিত : ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট স্থগিত
রাখে। পরবর্তীতে এই রিপোর্ট আর কার্যকরী করা হয় নি। এটাই ছিল শিক্ষা আন্দোলনের বড় সাফল্য।
২. আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন : ভাষা আন্দোলনের পর শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজ বুকের
তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে আরেকটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
৩. ‘শিক্ষা দিবস’ পালন : ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনার স্মরণে পরবর্তীকালে প্রতিবছর ১৭
সেপ্টেম্বরকে ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয় এবং আজো ছাত্রসমাজ এ দিবসটিকে গুরুত্বসহকারে পালন করে।
৪. ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত : ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে সোহরাওয়ার্দীর
আহ্বানে ৭ অক্টোবর সমগ্র পাকিস্তানে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়।
৫. আইয়ুব শাসন-বিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা লাভ : শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ স্থগিতের মধ্য দিয়ে
ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় পরবর্তীকালে আইয়ুব শাসন-বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রসমাজের প্রেরণা
হিসেবে কাজ করে ।
৬. স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের প্রধান শক্তিতে পরিণত : ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের
অন্যতম বড় সাফল্য এই যে, ছাত্ররাই পরবর্তীকালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়।

উসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ১৯৬২ সালের শিক্ষাআন্দোলন পূর্ব বাংলার ছাত্র-আন্দোলনের ইতিহাসে এক
গৌরবময় অধ্যায়। আইয়ুব খান কর্তৃক নিযুক্ত শিক্ষা কমিশন বিশেষ করে দারিদ্র্য-পীড়িত পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজের স্বার্থ-
বিরোধী শিক্ষা-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করলে সচেতন ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের সূচনা করে তা
বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে ব্যাপক আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। অতঃপর ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার তাজা রক্তের
বিনিময়ে ছাত্র স্বার্থ বিরোধী শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট স্থগিত হবার মধ্য দিয়ে শিক্ষা-আন্দোলনের সাফল্য অর্জিত হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস PDF :

দয়া করে ১ মিনিট অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষন এর মধ্যে আপনাকে ডাউনলোড পেইজ এ নিয়ে যাওয়া হবে। আপনাকে নিয়ে যাওয়ার পর আপনাকে হবে এই পেইজে ডাউনলোড লিংক দেওয়া হবে তাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। ধন্যবাদ। আরো অন্যান্য বই গুলো নেওয়ার জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। ধন্যবাদ আপনাকে দয়া করে ১ মিনিট অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষন এর মধ্যে আপনাকে ডাউনলোড পেইজ এ নিয়ে যাওয়া হ

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related