ভূমিকা : ৬ দফা কর্মসূচিভিত্তিক বাঙালির জাতীয় জাগরণকে নস্যাৎ করতে জেনারেল আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আশ্রয় নেন। কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত তার জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। সংঘটিত হয় ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। লৌহমানব আইয়ুবের পতন ঘটে। এ অভ্যুত্থান পূর্ববাংলার রাজনীতিতে নতুন মোড় এনে দেয়। বাঙালিরা এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের দীক্ষা লাভ করে।
‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল : ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল সব ধরনের গণতান্ত্রিক চেতনা ও আন্দোলন বিকাশের ইতিহাসে এক দেশ কাঁপানো সংগ্রাম। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল ছিল নিম্নরূপ
১. রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আলোচনার আমন্ত্রণ : গণঅভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব শাহীর ভিত কেঁপে উঠে। তিনি ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এক বেতার ভাষণে কিছুটা নতি স্বীকার করে বলেন, শিগগিরই আলাপ-আলোচনার জন্য আমি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিবর্গকে আমন্ত্রণ জানাব। যদিও এরপরও জুলুম, গুলি ও নির্যাতন বন্ধ হয় নি।
২. দৈনিক ইত্তেফাকের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার : গণঅভ্যুত্থানের চাপে আইয়ুব খান বাধ্য হয়ে ১৯৬৯-এর ৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন এবং সংবিধান সম্পর্কে আলোচনার জন্য গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দেন। আইয়ুব খান এটাও ঘোষণা করেন যে, তিনি পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না।
৩. আগরতলা মামলা প্রত্যাহার : আইয়ুবের কোনো প্রতিশ্রুতিই বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করতে পারে নি। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রনেতাগণ অবিলম্বে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান। ফলে আইয়ুব খান এ দাবিও মেনে নিতে বাধ্য হন।
৪. বন্দীদের মুক্তিদান : জনতার চাপে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সকল বন্দীকে বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়া হয় ।
৫. গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠান : ২৩ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে এক ‘গোলটেবিল বৈঠক’ অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে শেখ মুজিবসহ বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ যোগদান করেন। কিন্তু ৬ দফাভিত্তিক পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্বীকৃত না হওয়ায় আওয়ামী লীগ বৈঠক বর্জন করে আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। এ পরিস্থিতিতে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন ।
৬. আইয়ুব খানের পতন : শাসনতান্ত্রিক সমস্যার সমাধান না হওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নের জন্য জনগণকে নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করলে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে স্বৈরাচারী আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ সেনাবাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খানের উপর শাসন ক্ষমতা অর্পণ করে রাজনীতি থেকে চিরবিদায় নেন। এভাবে আইয়ুব খানের এক দশককালীন সামরিক শাসনের অবসান ঘটে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। আর এ নির্বাচনই ছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ।