আমলাতন্ত্রের কার্যাবলি কি :

আমলাতন্ত্রের কার্যাবলি
Functions of Bureaucracy

আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্র একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। এটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশবিশেষ। আমলাতন্ত্রের ভূমিকা প্রশ্নাতীত ও অপরিহার্য।

বর্তমানকালে প্রতিটি রাষ্ট্রের সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য সর্বতোভাবে আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল। শুধু ধনী দেশ নয়, দরিদ্র দেশগুলোও আমলাতন্ত্রের মতো বিশাল দক্ষ বাহিনী লালন করে।

এ বাহিনী অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও টেকনিক্যাল জ্ঞানসম্পন্ন। সরকারের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব ও কার্যাবলি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রসঙ্গে Prof. Finer বলেন, “The Function of the civil service in the modern state is not merely the improvement of government without it indeed, government would be impossible.””

অর্থাৎ, “আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের কাজ কেবল সরকার ব্যবস্থাকে উন্নত করা নয়; বস্তুত এটি ব্যতীত খোদ সরকার ব্যবস্থাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।”

আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্র যে বহুবিধ কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে তা নিচে উল্লেখ করা হলো-

১। সরকারি আইন ও নীতি কার্যকর করা :
সরকার রাষ্ট্র ও প্রশাসন পরিচালনা করতে গিয়ে নানা ধরনের আইন প্রণয়ন করে। আর সে আইনগুলো বাস্তবায়ন করাই হলো আমলাদের প্রধান কাজ।

আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন এবং বিচার বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত রায় বাস্তবায়ন আমলাতন্ত্রের মৌলিক কাজ।

এসব বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমলাতন্ত্র তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে এবং দৈনন্দিন কর্মপ্রবাহ সচল রাখে। অ্যালমন্ড ও পাওয়েল বলেন,

Bureaucrates enforce law, politics and decisions.” অর্থাৎ, সরকারি নীতি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অপরিহার্য ।

২। আইন প্রণয়ন : সাধারণত আইন প্রণয়ন করে আইন পরিষদ। কিন্তু আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন প্রণয়নের আগে আইনের খসড়া বিল আকারে সংসদে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ আমলারা করে থাকেন।

আমলাদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত খসড়া বিল রাজনৈতিক নেতারা সংসদে উত্থাপন করেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনভিজ্ঞতার কারণে আইনের খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে দেখতে পারে না। ফলে আমলাদের আইন প্রণয়নকাজে অংশ নিতে হয়।

৩। ধারাবাহিকতা বজায় রাখা : আমলাতন্ত্র সরকারি কাজে ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।

রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ফলে ভিন্ন ভিন্ন দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া নির্বাচনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দৈনন্দিন কার্যাবলি আমলাতন্ত্র করে থাকে।

আমলাতন্ত্র এ মধ্যবর্তী সময়ে প্রশাসনযন্ত্রকে সচল রেখে কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।

৪। রাজনৈতিক প্রশাসকদের পরামর্শদান:
রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাষ্ট্রের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি প্রণয়ন করে।

কিন্তু এসব নীতি প্রণয়নে আইনগত ও পদ্ধতিগত পরামর্শ দেন আমলারা। নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্তগ্রহণ-প্রক্রিয়া বেশ জটিল প্রকৃতির।

আমলাতন্ত্র এ জটিলতা নিরসন করে যথাসময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ করে থাকে।

ফাইনারের মতে, সমস্ত আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত উচ্চপর্যায়ের কর্মীবৃন্দ রাজনৈতিক শাসকদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

৫। বিচারসংক্রান্ত কাজ : বিচারসংক্রান্ত কাজে অংশগ্রহণ আমলাতন্ত্রের অন্যতম কাজ। অনেক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগীয় ও আইনভঙ্গজনিত বিচার সাধারণ আদালতে হয় না।

আমলাতন্ত্র বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এসব বিচার করে থাকে এবং দ্রুত জনগণের সমস্যার প্রতিকার করে থাকে।

এ প্রসঙ্গে অ্যালমন্ড ও পাওয়েল বলেন, “আধুনিক রাষ্ট্রে সাধারণ আদালতের বিচারক্ষমতার বাইরে অনেক বিষয় আছে। আমলাতন্ত্রের সদস্যরা সে বিচারকাজগুলো সমাধা করেন।

৬। তথ্য প্রদানের মাধ্যম হিসেবে দায়িত্ব পালন : আমলাতন্ত্রই হলো রাষ্ট্রের যাবতীয় তথ্যের রক্ষণাগার ও সরবরাহকারী।

সাংবাদিক, বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণ সরকারের বিভিন্ন নীতি, কর্মসূচি, তথ্যাদি পাওয়ার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভর করে।

আইনসভায় উত্থাপিত মন্ত্রীদের সব প্রশ্নের উত্তর আমলারাই তৈরি করে দেন। দেশের উন্নয়ন ও প্রগতি, চাহিদা ও সরবরাহ ইত্যাদি সব বিষয়ে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ ও দেনদরবার আমলাতন্ত্রের কাজ।

৭। স্বার্থগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ : আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বার্থগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত তাদের দাবিদাওয়া সরকারের কাছে জানায়।

সরকার আমলাদের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা, দরকষাকষি প্রভৃতির মাধ্যমে স্বার্থগোষ্ঠীর দাবিদাওয়া পূরণ করে থাকে।

এজন্য প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে স্বার্থগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ করে। এভাবে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা ও সমন্বয় সাধন করে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে।

৮। অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা : রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং দৈনন্দিন প্রশাসন পরিচালনা।

দেশের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আমলাতন্ত্র কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে । সব বিভাগ ও দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে আমলাতন্ত্র একমুখী ও জনকল্যাণমুখী শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে।

অ্যালান আর. বল বলেন, “A Final important function of bureaucracies is that of their own internal management.”

মিটিং, কনফারেন্স, আন্তবিভাগীয় কমিটি প্রভৃতির মাধ্যমে আমলাতন্ত্র অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা করে থাকে।

৯। সামাজিক কাজ : আমলাতন্ত্র মেধা ও দক্ষতার মাধ্যমে কাজ করে সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে।

এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষার প্রসার, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, দরিদ্রদের সাহায্য, দুস্থদের পুনর্বাসন ইত্যাদি।

সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নই হলো আমলাতন্ত্রের অন্যতম কাজ।

১০। সামাজিক পরিবর্তন ; আমলারা সমাজের সবচেয়ে সংগঠিত, শিক্ষিত ও পেশাদার শ্রেণি।

সমাজের সংস্কৃতি, রীতিনীতি, কলাকৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমলাতন্ত্র সামাজিক পরিবর্তনে কাজ করে থাকে।

আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রভাবিত করে জনমতকে পরিবর্তনের পক্ষে সংগঠিত করে।

১১। পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন : বর্তমানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার অনেকটা আমলানির্ভর।

রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক বজায় রাখতে আমলারা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকেন।

আন্তর্জাতিক চুক্তি, সন্ধি প্রভৃতি বিষয় নিষ্পত্তিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে আমলাতন্ত্র। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমলারা সরকারের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন।

১২। অর্থনৈতিক কাজ : একটি রাজনৈতিক সরকারের সফলতা নির্ভর করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের উপর।

ফলে আর্থিক নীতিনির্ধারণের জন্য সরকার আমলাতন্ত্রের সাহায্য নিয়ে থাকে। রাষ্ট্রের আর্থিক পরিকল্পনা, বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমলাদের। উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমলাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৩। আধুনিকীকরণ : আমলাতন্ত্র আধুনিক যুগের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান।

আমলাতন্ত্র আধুনিক একটি পেশাদার সংগঠন হিসেবে রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করে থাকে। আমলারা হন উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত ও প্রতিশ্রুতিশীল।

তারা বিভিন্ন দেশের সরকারি কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আধুনিক কলাকৌশল ব্যবহার করেন। আধুনিক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে অগ্রগামী করে তোলেন।
এজন্য তাদের বলা হয় রাষ্ট্রের আধুনিকীকরণীয় এজেন্সি ।

১৪। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা :
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আমলাদের সাহায্য- সহযোগিতা নিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হয়।

আমলারা সরকারের সুদৃষ্টি লাভের আশায় পরোক্ষভাবে সেই দলকে সাহায্য করেন, যাদের নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা থাকে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় আমলাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় ।

পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রে বা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।

রাষ্ট্রের কার্যাবলি ও প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র প্রধান নিয়ামক। উন্নয়নশীল দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সার্বিক ও সর্বাত্মক পরিবর্তন ও অগ্রগতিসাধনে আমলাতন্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related

৫ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট পাবেন সকল গ্রাহক কিভাবে নিবেন? 5 GB free internet all sim| How to take 5 GB internet free 2024...

৫ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট পাবেন সকল গ্রাহক: কিভাবে নিবেন?বাংলাদেশের...

সপ্তম / ৭ম শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি গাইড pdf গাইড ডাউনলোড ২০২৫| Class 7 Art & Culture Guide 2025

ভূমিকা: ৭ম শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি গাইড PDF ডাউনলোড...