পাঠ-৫.১ : অধিকার কি Rights:
অধিকার বলতে জীবনযাত্রার সেসব শর্ত বা অবস্থাকে বোঝায় যেটি ছাড়া মানুষ তার অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারে ৯ তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ সাধিত হয় না এবং সমাজজীবনের উন্নতিতে কোনো অবদান রাখতে পারে না।
অধিক কথাটি অত্যন্ত ব্যাপক এবং মানুষের আত্মোপলব্ধি বা পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধাই প অন্তর্ভুক্ত।
প্রতিটি নাগরিকের সুন্দর সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য কতকগুলো সামাজিক রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধার যেমন প্রয়োজন, পাশাপাশি প্রয়োজন অর্থনৈতিক স্বাধীনতার,
যেমন— অন্ন, বস্ত্র ও কর্মে সংস্থান এবং অভাব থেকে মুক্তি।
সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ব্যক্তির জীবনে পূর্ণাঙ্গতা আনয়ন করে।
তবে এই সুযোগ-সুবিধাগুলো অবশ্যই রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে এবং সঙ্গে সত সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা থাকতে হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২০নং অনুচ্ছেদের (১)-এ বলা হয়েছে, য হচ্ছে কর্মক্ষম প্রতিটি নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয় এবং “প্রত্যেকের নিকট হয়ে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী”
— এই নীতির ভিত্তিতে সবাই নিজের কাজের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করবেন।’
তাই অধ্যাপক হ্যারল্ড জে. লাস্কি (Harold J. Laski) যথার্থই বলেছেন যে, “Every State is known by the right that it maintains.”
অর্থাৎ, “প্রতিটি রাষ্ট্র তার অধিকার সংরক্ষণের দ্বারাই পরিচিত হয়।” ব্যক্তি তার স্বীয় ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে সেগুলোই হলো অধিকার।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা অধিকারকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো-
অধ্যাপক হব হাউজ (Hob House)-এর মতে, “Genuine rights are conditions of social welfare and the various rights owe their validity to the functions they perform in the harmonious development of society.”
অর্থাৎ, “যথার্থ অধিকার বলতে সামাজিক কল্যাণসাধনের কতকগুলো শর্তকে বোঝায় এবং বিভিন্ন অধিকারের বৈধতা সমাজে সর্বাঙ্গীণ উন্নতিবিধানের উপর নির্ভরশীল।”
দার্শনিক টি. এইচ. গ্রিন (T. H. Green) বলেন, “Rights are the outer conditions essential for man’s inner development.”
অর্থাৎ, “অধিকার হলো সেসব বাহ্যিক অবস্থা, যা মানুষের আত্মিক উন্নতি সাধন করে।”
Wilde, “Rights are a reasonable claim to freedom in exercise of certain activities.”
*অধিকার হলো কতিপয় নির্দিষ্ট কার্যাবলি স্বাধীনভাবে অনুশীলন করার একটি যুক্তিসংগত দাবি।”
অধ্যাপক হল্যান্ড (Holland)-এর মতে, “Rights are man’s capacity of influencing the acts of another by means of the opinion and force of the society.”
অর্থাৎ, “কোনো ব্যক্তি কর্তৃক অপর ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কর্মকাণ্ডকে সমাজের মতামত ও শক্তি দ্বারা প্রভাবিত করার ক্ষমতা হলো অধিকার।”
পরিশেষে বলা যায়, অধিকার হলো সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত কতগুলো সুযোগ-সুবিধা, যা ভোগের মাধ্যমে নাগরিকের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে।
অধিকার ব্যতীত মানুষ তার ব্যক্তিত্বকে অনুধাবন করতে পারে না। অধিকারের মূল লক্ষ্য ব্যক্তির সর্বজনীন কল্যাণসাধন।
রাষ্ট্রের নাগরিকদের মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য অধিকার অপরিহার্য।
একক কাজ : অধিকার নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশে কীভাবে সহায়তা করে ?
অধিকারের বৈশিষ্ট্য
Characteristics of Rights
অধিকারের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, নিচে তা উল্লেখ করা হলো—
১। সামাজিক ধারণা : সমাজে বসবাসরত সব মানুষই অধিকারের দাবিদার। সমাজে বসবাস করতে গিয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা বাস্তবায়নে অধিকারের সৃষ্টি হয়েছে।
সুতরাং, এটি সামাজিক ধারণাপ্রসূত একটি বিষয়। যদিও পরবর্তীকালে রাষ্ট্র এটিকে আইনগত ধারণার মাধ্যমে সংরক্ষণ করে ।
২। সুযোগ-সুবিধার সমন্বয় : ব্যক্তির জীবন বিকাশে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার সমন্বিত রূপ হলো অধিকার।
ব্যক্তির জীবনের পরিপূর্ণতা লাভের জন্য সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন প্রকার অধিকার লাভ করে থাকে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে তার একটি সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
৩। সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট : সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজে বসবাস করে বলে সমাজের সাথে তার ব্যক্তি জীবনের সম্পর্ক রয়েছে।
সে কারণেই মানুষ সমাজ থেকে নানা অধিকার ভোগ করে থাকে।
৪। রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত : নাগরিকতার মাধ্যমে ব্যক্তির রাষ্ট্রীয় পরিচয় ফুটে ওঠে। রাষ্ট্রের সব আইনকানুন নাগরিকরা মেনে চলে।
নাগরিকের অধিকার বাস্তবায়ন করার জন্য রাষ্ট্রের অনুমোদন প্রয়োজন। অর্থাৎ, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অপরিহার্য।
৫। সর্বজনীন কল্যাণ : অধিকারের মূল লক্ষ্য ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সর্বজনীন কল্যাণসাধন।
রাষ্ট্র কোনো বিষয়কে অধিকার হিসেবে তখনই বিবেচনায় নেয়, যখন সেটি সবার জন্য কল্যাণকর মনে হয়।
ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ, এমন কোনো দাবি অধিকার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
৬। পরিবর্তনশীল : সমাজ ও সভ্যতার পরিবর্তনের সাথে সাথে অধিকারের ধরন ও মাত্রা পরিবর্তিত হয়।
যেমন- প্রাচীনকালে রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার তেমন ছিল না। কিন্তু আধুনিককালে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
এ অধিকার খর্ব হলে নাগরিকগণ এর প্রতিকারের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে পারে।
৭। প্রয়োজনের নিরিখে সৃষ্ট : অধিকার আগে থেকে প্রচলিত ছিল এমনটি বলা যায় না।
কিন্তু মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাস করার জন্য অধিকারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
সেই প্রয়োজনের নিরিখেই সমাজ ও রাষ্ট্র অধিকারের স্বীকৃতি দেয়।
৮। গতিশীলতা : সমাজ পরিবর্তনশীল, সমাজে বসবাসকারী মানুষের প্রয়োজনীয়তাও পরিবর্তনশীল।
অধিকার সমাজজীবনের চূড়ান্ত ও স্থায়ী কোনো বিষয় নয়। সমাজ যেমন গতিশীল তেমনি অধিকারও সময়ের সাথে সাথে গতিশীল একটি দাবি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, অধিকার সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট, রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত ও সংরক্ষিত এক ধরনের ক্ষমতা বা দাবি,
যা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়ক এবং যার মাধ্যমে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।