১১ প্রশ্ন : ২.৭ অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা কি? এটি ব্যর্থতার কারণসমূহ বিশ্লেষণ কর। অথবা, অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা কর। এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল কেন?

 উত্তর :

 ভূমিকা : 

১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা ক্ষমতায় আসার পর প্রায় ২০০ বছর এদেশ শাসন করেছে । এ সময় ব্রিটিশ সরকার এদেশের মানুষের উপর নানা রকম নির্যাতন ও অত্যাচার চালায় । তাদের এই অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ একসময় তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে । এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার তাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ ঘোষণা করে । ঠিক এমন সময়ে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অভিন্ন স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেন । তার প্রস্তাব অনেক নেতৃবৃন্দ সমর্থন জানালেও বিভিন্ন কারণে অভিন্ন স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ব্যর্থ হয় ।

অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা : 

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্বাধীন-যুক্ত বাংলা বা অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন । মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারণার বিপরীত ছিল তার এ পরিকল্পনা । তিনি ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করেন । এ আলোচনার পর পরই দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী ‘স্বাধীন বাংলা’ পরিকল্পনা ঘোষণা করেন । সার্বভৌম যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার যে প্রস্তাব তিনি আনয়ন করেন তাই ইতিহাসে ‘বৃহৎ বঙ্গ পরিকল্পনা’ বা অখণ্ড বাংলা পরিকল্পনা নামে অভিহিত ।

অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার কারণ : 

অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব যেসব সুনির্দিষ্ট কারণে ব্যর্থ হয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :

 হিন্দু নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ :

 ভারত বিভক্তির ঠিক এক দশক থেকে বাংলায় হিন্দুরা সরকার পরিচালনায় তেমন কোনো সুযোগ পায়নি। এক্ষেত্রে মুসলিমরা এগিয়ে ছিল। ফলে হিন্দু নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক হতাশা ও এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ জন্ম নেয় । এ অবস্থার জন্য সর্বভারতীয় হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক মেরুকরণ বহুলাংশে দায়ী ছিল । আর এ থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলা বিভক্তির মানসিকতা সৃষ্টি হয় ।

 হিন্দুদের তীব্র বিরোধিতা : 

শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের একটি অংশ অখণ্ড ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র গঠনের তীব্র বিরোধিতা করে এবং বাংলাকে বিভক্ত করে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেয় । এমতাবস্থায় কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বাংলা বিভাগের পক্ষে প্রস্তাব দেয় । তাদের প্রধান যুক্তি ছিল ভারত বিভক্ত হলে একই ভিত্তিতে বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করতে হবে।

 সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা :

 ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে” সংঘটিত ভয়াবহ কলকাতা দাঙ্গার পর থেকে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে স্বার্থান্বেষী হিন্দু মালিকানাধীন পত্রিকাগুলো বাংলা বিভক্তির পক্ষে প্রচারণা চালাতে থাকে যা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহের প্রাচীর গড়ে তুলতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। মূলত কলকাতা দাঙ্গার পর হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি ঘটে ।

 কংগ্রেস হাইকমান্ডের বিরোধিতা :

 সোহরাওয়ার্দীর অভিন্ন স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব হিন্দুরা মোটেও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে নি । তারপরও সোহরাওয়ার্দীর অখণ্ড স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব পাস না হওয়ার অন্যতম কারণ কংগ্রেস নেতা নেহেরু ও প্যাটেলের ভেটো প্রয়োগ । স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্রের ভাগ্য কার্যত, বাংলার বাইরে সর্বভারতীয় পর্যায়ে নির্ধারিত হয় ।

জিন্নাহর নীরবতা :

 অখণ্ড স্বাধীন বাংলার আন্দোলন চলাকালে জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবে সমর্থন জানালেও প্রকাশ্য কোনো মন্তব্য করেন নি; বরং সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম যে সময় বাংলার অন্য সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছার শর্ত নিয়ে আলাপ-আলোচনায় নিয়োজিত ছিলেন সে সময় জিন্নাহর কাছ থেকে তার অনুগত “খাজা গ্রুপ” এমন ধারণা দিয়েছিল যে, হিন্দু নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য মুসলিম লীগ হাইকমান্ড থেকে কাউকে ক্ষমতা দেওয়া হয় নি ।

নেহেরু প্যাটেলের বিরোধিতা : 

বাংলার রাজনৈতিক সংকট নিরসনে উভয় সম্প্রদায়ের কতিপয় নেতার স্বাক্ষরিত চুক্তি যদিও একটি যুক্তিসম্মত ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছিল তথাপি এর প্রতি কংগ্রেস হাইকমান্ড নেহেরু ও প্যাটেলের প্রতিক্রিয়া আদৌ সহায়ক ছিল না। অখণ্ড স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনাকে একটি ফাঁদ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্যাটেল বাংলার কতিপয় প্রখ্যাত হিন্দু ও কংগ্রেস নেতাদের এ ফাঁদে পা না দেওয়ার জন্য সতর্ক করে দেন । তিনি আরো অভিমত ব্যক্ত করেন। যে, বাংলার অমুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে অবশ্যই বাংলাকে বিভক্ত করতে হবে । অপরপক্ষে নেহেরু একধাপ এগিয়ে বলেন, অভিন্ন বাংলা মানে মুসলিম লীগের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। বস্তুত কংগ্রেস হাইকমান্ড বাংলা বিভক্তির পক্ষে অটল ছিল আর এজন্য তারা অভিন্ন স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠন পরিকল্পনার প্রতি তাদের সর্বাত্মক বিরোধিতা অব্যাহত রাখে ।

 আসামের গুরুত্ব :

 আসাম ছিল পেট্রোল ও খনিজ সম্পদে ভরপুর। এজন্য কৌশলগত দিক দিয়ে আসাম ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । আর অখণ্ড স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠিত হলে আসাম ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতো। ফলে ভারতের মূল ভূখণ্ডে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা থাকত না। বাংলার সাথে যোগাযোগ করতে হলে তাকে ট্রানজিট সুবিধা নিতে হতো ।

 দীর্ঘস্থায়ী না হবার আশঙ্কা :

 কংগ্রেস হাইকমান্ড বিশ্বাস করে যে, বাংলা বিভক্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে না । অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক কোনো দিক বিবেচনায় এককভাবে পূর্ববাংলার পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। মাউন্ট ব্যাটেন এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন নেহেরু মনে করেন বর্তমান বাংলা ভাগ হলেও কয়েক বছরের মধ্যে বাংলা হিন্দুস্তানের মধ্যে চলে আসবে ।

ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব :

 তখনকার ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম জনপ্রিয় বাঙালি নেতা ছিলেন। বাঙালি জাতি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে তাদের আগ্রহের কমতি ছিল না, কিন্তু তারা তাদের চিন্তাকে যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য দূরদর্শিতা ও দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন। তাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রবল থাকায় তারা এ পর্যায়ে বাঙালি জাতি রাষ্ট্র গঠনে প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হন নি । ফলে স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় ।

 হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দের অনৈক্য :

 অভিন্ন স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠন প্রশ্নে হিন্দু-মুসলিম নেতাগণ ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না । অভিন্ন বাংলা প্রশ্নে অনেকেই একে সমর্থন জানালেও বিরোধী মতেরও অভাব ছিল না। এ বিষয়কে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসে দুটি ভিন্ন মতের সৃষ্টি হয় ।

উপসংহার : 

পরিশেষে বলা যায় যে, সকল প্রকার অত্যাচার-নিপীড়নের অবসানের পর ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের বিভক্তি প্রায় চূড়ান্ত ঠিক তার আগ মুহূর্তে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করেন । তার এ প্রস্তাব অনেকেই সমর্থন জানালেও কংগ্রেস নেতাদের বিরোধিতা ও ব্রিটিশ সরকারের অনিচ্ছার কারণে শেষ পর্যন্ত অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ভেঙে যায় । সোহরাওয়ার্দীর মতে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারলে এটা একটি মহান দেশে পরিণত হতো, ভারতীয় উপমহাদেশে যা হতো সবচেয়ে সমৃদ্ধ ।

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related

৫ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট পাবেন সকল গ্রাহক কিভাবে নিবেন? 5 GB free internet all sim| How to take 5 GB internet free 2024...

৫ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট পাবেন সকল গ্রাহক: কিভাবে নিবেন?বাংলাদেশের...

সপ্তম / ৭ম শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি গাইড pdf গাইড ডাউনলোড ২০২৫| Class 7 Art & Culture Guide 2025

ভূমিকা: ৭ম শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি গাইড PDF ডাউনলোড...